জানুয়ারি মাস। নবম শ্রেণীর ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রথম দিনেই ক্লাস আরম্ভ হবার আগে স্কুলের মাঠে এসেম্বলি ডাকলেন নবনিযুক্ত প্রধান শিক্ষিকা নাসরিন জাহান। তিনি মাঠে প্রবেশ করে সবাইকে শুভেচ্ছা জানালেন। বললেন, 'তোমরা সবাই আমার চোখে সমান'। কিন্তু পরে তিনি বুঝেছিলেন কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। সেদিন মেয়েদের সারিতে পেছনের দিকে মনমরা ও জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল আনোয়ারা নামের একটি মেয়ে। তার জামা কাপড় ময়লা। চুল উশকো খুশকো। হাত-পা অপরিষ্কার। প্রথম দিন দেখে নাসরিন ম্যাডাম অখুশি হলেও কিছু বললেন না। কিন্তু পরে ক্লাসে গিয়ে দেখা গেল, সে লেখাপড়ায়ও অমনোযোগী।
কয়েকদিন পরের কথা। সেদিন নাসরিন ম্যাডাম ছাত্রীদের বিগত বছরগুলোর পরীক্ষার ফলাফল দেখছিলেন। তিনি একে একে প্রতিটি ছাত্রের ফলাফল দেখলেন। সবার শেষে দেখলেন আনোয়ারার ফলাফল। দেখে তিনি আশ্চর্য হলেন। আনোয়ারা সম্পর্কে ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষকের মন্তব্য খুব চমৎকার। তিনি লিখেছেন : "আনোয়ারা হাসিখুশি বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে নিয়মিত ও ভালোভাবে পড়ালেখা করে। তার বিদ্যালয়ের কার্যক্রম প্রশংসনীয়। তার আচরণও বেশ মার্জিত।'
সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষিকা মন্তব্য করেছেন : 'আনোয়ারা বেশ চৌকস মেয়ে। ক্লাসের সবাই তাকে পছন্দ করে। কিন্তু তার মনে ভীষণ কষ্ট। কারণ, তার মা অসুস্থ ও দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত।' অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষক লিখেছেন, 'মায়ের মৃত্যু আনোয়ারাকে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছে। সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। স্কুলের ব্যাপারে তার উৎসাহ নেই বললেই চলে। সে একলা থাকে আর প্রায়ই ক্লাসে বিমর্ষ থাকে।' নাসরিন আপা এবার সচেতন হলেন। তিনি আনোয়ারার সমস্যা বুঝতে পারলেন।
আনোয়ারার মা মারা গেছে প্রায় এক বছর কেটে গেছে এরপর ওর বাবা ওকে একাই দেখভাল করেছেন। ওর মায়ের জিনের প্রভাবে আনোয়ারা বেশ ছিপছিপে গড়নের, লম্বাটে মুখ ও নাভি পর্যন্ত লম্বা কালচে বাদামী ঘন চুল পেয়েছে। যাই হোক মা মারা যাবার পর আনোয়ারা যে আঘাত পেয়েছে সেজন্য সে ইদানিং স্কুলের ড্রেসকোডও ভুলতে বসেছে। নাসরিন ম্যাডাম মা মরা মেয়ে জেনে প্রথম প্রথম কিছু বলতে চাননি কিন্তু একসময় আনোয়ারার এই নিয়ম ভাঙাটা অন্য ছাত্রছাত্রীদেরও অনুকরণীয় হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্ররা তো বটেই ছাত্রীরাও ড্রেসকোড ভাঙা শুরু করে।
স্কুলের নিয়মানুযায়ী যেখানে ছাত্ররা চুলে আর্মি কাট দিয়ে চুল সার্বক্ষণিক এক ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের মধ্যে ও কানের পাতা থেকে উপরে রাখার কথা সেখানে ছেলেরা চুল বড় রেখে দিতে শুরু করে। ছাত্রীদের জন্য স্কুলে চুল বেঁধে আসা ও স্কুল ক্যাম্পাসে থাকাকালীন চুল খোলা রাখা নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু আনোয়ারা যেহেতু সকালে গোসল সেরে সরাসরি ভেজা চুল খোলা রেখেই চলে আসত সেজন্য অন্য ছাত্রীরাও তেমন করা শুরু করে। এছাড়াও মেয়েদের চুল বাঁধার জন্য সাদা হেয়ারব্যান্ড ও ফিতা নির্দিষ্ট ছিল কিন্তু আনোয়ারা যেহেতু চুল বাঁধত না আর কদাচিৎ বাঁধলেও ইচ্ছামত রংবেরঙের ক্লিপ বা রিবন লাগাত তাই অন্যান্য ছাত্রীরাও এই নিয়মটাকে আগের মত গুরুত্ব দেয়া বন্ধ করে দেয়। এমনকি কালার করা চুল নিয়েও স্কুলে হাজিরা দিতে থাকে।
একদিন নাসরিন ম্যাডাম নবম শ্রেণীর শ্রেণীকক্ষে রোলকল করার সময় জনৈক ছাত্রীকে পাম্প করা চুলসহ দেখলেন। তিনি সেই ছাত্রীকে দাঁড় করিয়ে বেশ খানিকক্ষণ ভর্ৎসনা করার পর মেয়েটি হঠাৎ করেই বলে উঠল কিন্তু ম্যাম আনোয়ারা যে প্রতিদিন খোলা চুলে স্কুলে আসছে; নোংরা পোশাক, কেডস পরে ক্লাস করছে ওকে কেন কিছু বলছেন না?
ম্যাডাম অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সকল ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পেছনের বেঞ্চিতে কোণায় বসা আনোয়ারাকে দেখেন।
হ্যাঁ বরাবরের মতই আনোয়ারা অবন্ধিত চুলে উস্কখুস্ক বেশে বসে আছে। তিনি দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আনোয়ারাকে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করলেন আনোয়ারা তুমি এমন ভাবে স্কুলে আসো কেন? তুমি কী জানো না এই স্কুলের সব মেয়েদের চুল বেঁধে আসাটা নিয়ম? তোমার চুল খোলা কেন? এই বলে ম্যাডাম অতঃপর সামনে পাম্প করা চুলের মেয়েটিকে হাত পাততে বললেন ও ওর হাতের তালুতে নিজ হাতে থাকা কাঠের রুলার দিয়ে মারলেন এবং মেয়েটিকে বসতে বলেন ও সঙ্গে হুমকি দিলেন পরদিন ক্লাসে চুল স্বাভাবিক না করে আসলে টিসি দিবেন।
এরপর আনোয়ারার দিকে এগিয়ে এসে ওর বাহুতে আলতো করে রুলার ছুঁইয়ে স্কুল ছুটির পর ওনার অফিস কক্ষে থাকতে বলেন। যথাসময়ে স্কুল ছুটি হলে আনোয়ারা বাধ্য মেয়ের মত প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে হাজির হলো। হেডমিস্ট্রেস তখন ওর হাতে নিজের মুঠোফোন তুলে দিয়ে বলেন ওর আব্বুকে কল করতে। আনোয়ারা অস্ফুট স্বরে প্রত্যাখ্যান করতে চাইলেও ম্যাডামের আরক্ত চোখ দেখে মিইয়ে গিয়ে ওর আব্বুকে কল করে স্কুলে আসতে বলল।
আধঘণ্টা পর আনোয়ারার আব্বু জনাব শহীদ ওয়ালী এসে পৌঁছুলেন। তিনি হেডমিস্ট্রেসের রুমে ঢুকেই দেখলেন তার মেয়ে বিশাল চেয়ারে বসা হেডম্যাডামের পাশে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঢোকার পরই ম্যাডাম তাকে তার ডেস্কের অপর পাশে রাখা চেয়ারে বসতে বলেন এবং বসার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন।
– আনোয়ারা কী আপনার নিজের মেয়ে?
– হ্যাঁ আমি আনোয়ারার বাবা। এমন প্রশ্ন কেন?
– আমি শুনেছি আপনার স্ত্রী মারা গেছেন যার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই আপনার মেয়েকে নিয়ে আপনার থেকে দূরে থাকতেন না?
– না আমরা একসঙ্গেই থাকতাম।
– কিন্তু আপনার মেয়েকে দেখে আমার কখনো মনে হয় না আপনার সঙ্গে ওর সেরকম সম্পর্ক আছে? দেখুন ও কেমন অগোছালো। অন্য সকল মেয়েরা স্কুলে কত পরিপাটি হয়ে আসে অথচ আপনার মেয়েকে দেখুন। আকাচা ড্রেস, খোলা চুল, ময়লা জুতা মোজা। আর ও শুধু আজকে নয় বলতে গেলে নিয়মিত এভাবে স্কুলে ক্লাস করছে। দেখুন মা মরা মেয়ে বলে আমি এ্যাদ্দিন কিচ্ছু বলিনি কিন্তু ওকে দেখে অন্য ছাত্রছাত্রীরা দিনকে দিন বখে যাচ্ছে। ওকে দৃষ্টান্ত বানিয়ে অন্য মেয়েরাও স্কুলের নিয়ম ভাঙার সাহস দেখাচ্ছে। এমনটা চলতে দেয়া যায় না।
– (আনোয়ারার দিকে এক নজর তাকিয়ে) জ্বী আমি বুঝতে পারছি।
– দেখুন মিঃ শহীদ আমি অনুভব করতে পারি যে সিঙ্গেল প্যারেন্টদের জন্য সবদিক সামলানোটা কতটা কঠিন। কিন্তু আপনাকে তো আপনার মেয়েকে দেখেশুনে রাখতে হবে। ওর ভালোমন্দের খোঁজখবর নিতে হবে। সো প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আপনার মেয়ের দায়িত্ব এখন পুরোটাই আপনার ওপরে। স্কুলে ও যতক্ষণ আছে ততক্ষণ ও আমাদের জিম্মাদারি; কিন্তু ও যদি স্কুলের নিয়ম মেনে না চললে তো আমরা ওকে স্কুলে রাখতে পারব না।
– (মাথা নেড়ে) হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন।
– প্লিজ ওকে একটু পরিষ্কার ও ফিটফাট হয়ে স্কুলে আসতে বলবেন। আর আনোয়ারা এদিকে এসো।
আনোয়ারা ম্যাডামের হাতের নাগালে এসে দাঁড়ায়।
–(চুলের ডগা আঙুলের ভাঁজে নিয়ে) আচ্ছা তুমি কী চুলে তেলও দাও না বা আঁচড়াও না?! কত সুন্দর লম্বা চুল তোমার অযত্নে তো ডগা চিরে রুক্ষ শুষ্ক হয়ে গেছে। (মিঃ শহীদের চোখে তাকিয়ে) দেখছেন তো মিঃ শহীদ।
– হ্যাঁ দেখেছি। আমি এর আগে অনেক বার বলেছি। এখনও প্রতি সকালেই ওকে কত করে বোঝাই লম্বা চুল রাখতে গেলে যত্ন করতে হয়। চুলে তেল দিবে ও শ্যাম্পু করবে। প্রতিদিন দুই বেলা চুল আঁচড়াবে। কিন্তু ও তো কথা শুনবার পাত্রী নয়। চিরুনি ও ব্রাশ হাতে নিয়েও পরে রেখে দেয়। আঁচড়ানোর চেষ্টা অবধি করে না; কিছুক্ষণ পরেই দেখি গেম খেলতে বসে গেছে। কতবার ভয় দেখিয়েছি যে চুল না আঁচড়ালে চুল কেটে দিবো তবুও পাত্তা দেয়নি। আসলে ওর মা বেঁচে থাকতে এসব ওর মা নিজেই করত। মা মরা মেয়ে একটু জোরে কথা বলতে গেলেও খারাপ লাগে, গায়ে হাত তোলা তো দূর অস্ত। তাই এখন আগের মতন জোরও করি না।
– না প্লিজ গায়ে হাত তোলার দরকার নেই। (আনোয়ারার দিকে তাকিয়ে) আব্বুর কথা শোনো আনোয়ারা। তিনি তো তোমার ভালোই চান। তবে তোমার যদি একান্তই চুল আঁচড়াতে, চুল বাঁধতে ইচ্ছা না করে তাহলে চুল এমন করে কাটিয়ে ফেলো যাতে আর চুল বাঁধতে না হয়। আর চুলে একটু তেল মেখে চুল কালো ক্লিপ দিয়ে এঁটে রেখো। এভাবে বাতাসে উড়তে দেখলে ভাল লাগে না। বেশ এবার তাহলে তুমি বাসায় যাও। মিঃ শহীদ আপনারা এবার যেতে পারেন।