সুন্দরী লম্বা চুলের মেয়ে। তার কোমর অবধি লম্বা চুল ছিল। সে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করছে, যেখানে সে কেবল গত মাসে যোগদান করেছে। সে আজই তার ১ম মাসের মাইনে পেয়েছে। এই মুহূর্তে সে একটি বড় বিপণী বিতানের সামনে দাঁড়িয়ে তার বাবার জন্য কি কিনবে তা ভাবছে। সুন্দরী তার বাবাকে ভালবাসে, তার মা নেই। তার মা তার বোঝবার বয়স হবার আগেই মারা যান। এর পরে তার বাবা বহু লড়াই করে তাকে এতদূর এনেছে। সুন্দরী এটা কখনোই ভুলে যাবে না। তাই সে তার ১ম মাইনের টাকায় বাবাকে কিছু উপহার দিতে চায়। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। তার বাবার স্বপ্ন তার মেয়ের বিয়ে। তবে সুন্দরী তার বাবার কারণেই তার বিয়ের জন্য প্রস্তুত না। সে তার বাবার যত্ন নিতে চায়। তবে তার বাবা তার বিয়ের জন্য বেশ পীড়াপীড়ি করায় সে বলেছিল দুই বছর পর সে বিয়ে করবে। তার বাবাও এটি মেনে নিয়েছিল।
সুন্দরী তার বাবার জন্য রেশমের ধুতি এবং নতুন ফতুয়া কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অতএব সে মিষ্টির দোকানে গিয়ে মিষ্টি কিনে বেরিয়েই কাপড়ের দোকানে ঢুকে একটি সুন্দর ধুতি ফতুয়ার সেট কিনে ফেলে। তারপর পথে বেরোতেই হঠাৎ তার চোখে বাবার সঙ্গে কাটানো নিজের শৈশবের দৃশ্য কল্পনায় ভেসে উঠল। ২ বছর বয়সেই তার মা আচমকা মারা যান। এরপর থেকে তার ছোট্ট জগৎ জুড়ে কেবল তার বাবারই অস্তিত্ব আছে, তার মায়ের মুখ কেমন সে তো তা ভুলেই গেছে অবশ্য তার বাবাই এমনটা করেছেন যাতে সে কষ্ট না পায়। তার মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবার বন্ধু শুভানুধ্যায়ীদের অশেষ পীড়াপীড়িতেও তার বাবা তাকে রেখে দ্বিতীয় সংসার পাততে রাজি হননি এমনকি কয়েক বছর আগে যখন সে সবে স্কুল শেষ করেছে তখনো তারা হাল ছাড়েননি। যা হোক সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। ৩ বছর বয়সে গ্রামের মন্দিরে তার মুণ্ডনের আয়োজন করা হয়। সে চকচকে ক্ষুরের ফলা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল কিন্তু তার বাবা তাকে মুণ্ডন করাতে রাজি করেছিল। এবং তার ৬ বছর বয়সে সে একটি স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল। তার বাবা তাকে তার স্কুলে ছেড়ে আসতেই প্রথম দিনে সে অনেক কাঁদল। এর কিছুদিন পরেই তার বাবা আবার তার মাথা মুড়াতে চায় তবে সে আর সায় দেয়নি। কারণ তার চুল বেশ লম্বা হয়েছিল এবং তার চুলের ওপর মায়া পড়ে গেছিল। সে নিজের যত্ন নিবে এবং চুলের জন্য অসুখ বাঁধাবে না বলেছিল তাই তার বাবাও তাকে আর জোর করে না। এর পর থেকে সে তার চুল লম্বা করতে থাকে। কলেজ অবধি সে চুলে বলতে গেলে কাঁচিই ছোঁয়ায়নি। কেবল মাঝেমধ্যে চুলের সামান্য ডগা ছাঁটিয়েছে। ভাবতে ভাবতে সে তার লম্বা চুলে হাত বোলায় ও সামনে তাকিয়ে দেখে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
এক গাল হাসি নিয়ে বাড়ির উঠানে পা দিয়ে দেখল, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে! হ্যাঁ, তার বাবা মারা গেছেন। ঘুমন্ত অবস্থায় স্ট্রোক করে তিনি মারা যান। সে তার বাবাকে ডেকে জাগানোর চেষ্টা করে কিন্তু মৃত কি তাতে সাড়া দিতে পারে? সে কি করবে বুঝতে পারে না, তার চোখ বেয়ে পানি গড়াতে থাকে আর সেই ঘোলা চোখ নিয়েই সে তার বাবার মৃতদেহের উপর ঢলে পড়ে। কিছু সময় পরে প্রতিবেশীরা তার কান্নার আওয়াজ শুনে জড়ো হয় এবং সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে তার আত্মীয়-স্বজনদের বাবার মৃত্যু সংবাদ পাঠাতে থাকে। তার বেশিরভাগ আত্মীয়ই দূরে দূরে থাকে। তাই তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন এসেছিল। এছাড়াও তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীতে পুরুষের সংখ্যা কম, তাদের অধিকাংশই মহিলা। তাই তার প্রতিবেশীরা তার বাবার শেষকৃত্যের জন্য তাকে সাহায্য করছে এবং তারা স্বল্পসময়ের মধ্যে চূড়ান্ত অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছে।
পরের দিন সকলেই জিজ্ঞাসা করছিল কে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করছে? কারণ মৃত পুরুষের যদি কোনো পুত্র বা জামাতা থাকে সাধারণত তারা দাহাধিকারী হয় তবে সুন্দরীর বাবার সন্তান বলতে তার একমাত্র কন্যা সুন্দরীই আছে তবে সেও অবিবাহিতা এবং তার কোনো তুতো ভাই নেই বা কাকাও নেই। অবশেষে সুন্দরী বলল আমিই আমার বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করব। প্রাথমিকভাবে প্রত্যেকেই অমত করল পরে কিছুক্ষণ পর কোনো বিকল্প খুঁজে না পেয়ে সকলেই সম্মতি দিল। তারা তার বাবার শবের ওপর ফুলের মালা চড়িয়ে একফালি কাপড় দিয়ে ঢেকে দাহক্ষেত্রে নিয়ে যায়। সুন্দরীও পিছন পিছন যাচ্ছে। এই ভিড়ের মধ্যে অধিক সংখ্যক মহিলাই রয়েছেন। শ্মশানে পৌঁছেই তার বাবার মরদেহের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে কুশের ওপর শুইয়ে দেয়া হয়।
সকলে চিতার জন্য কাঠ আর খড় যোগাড় করা আরম্ভ করে সুন্দরীর প্রিয় আমগাছটা যেখান থেকে সে খেলার সাথীদের সঙ্গে ছোট বেলা আম কুড়োতো তার গুঁড়িটা বাদে প্রায় সব ডাল কেটে ফেলা হয়। এর মাঝে পারিবারিক পুরোহিত তাকে স্নান করে আসতে বলেন। কিন্তু এদিকে আবার গোল বাঁধল দাহের আগে যে মৃতদেহের স্নান প্রয়োজন। এখন উপস্থিত সবার সিদ্ধান্তে সুন্দরী এরই মধ্যে দাহ করার তৈয়ারি করে ফেলেছে তাই আর ওকে বাঁধা দেয়া সাজে না। অগত্যা উপস্থিত শ্মশানযাত্রীরাই কয়েকজন স্নান সেরে সুন্দরীর বাবার গায়ে তেল ও কাঁচা হলুদ মেখে স্নান করান এবং মৃতদেহের কপালে চন্দন দিয়ে, মালা দিয়ে, নতুন কাপড়ে জড়িয়ে দেন এবং ৭ ছিদ্রে (চোখ, কান, নাসারন্ধ্র ও মুখ) কাঁসার দানা ঢুকিয়ে দেন। এবার সুন্দরীর কাজ পিণ্ডদান করার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। ইতিমধ্যে চিতা তৈরি এবং চন্দনের টুকরোও দেয়া হয়েছে। কয়েকজন মিলে লাশটা চিতায় তুলে দিলেন আর একজন মুখাগ্নি করার জন্য এক আঁটি খড় জ্বালিয়ে সুন্দরীর হাতে তুলে দেয়। সে মন্ত্র পড়ে ৩ চক্কর কেটে চিতায় আগুন দিলো। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল চিতা। কয়েক মিনিট পর দাহ শেষে ১২ আঙ্গুল সমান আমকাঠ নিয়ে ৭ বার চক্কর কেটে প্রতিবার ১টি ধনিচার কাঠি চিতায় দিলো ও পরক্ষণে পুরুতের হাত থেকে কুড়াল নিয়ে জ্বলন্ত চিতার ওপর ৭ কোপ দিলো। এরপর শ্মশানবন্ধুরা প্রত্যেকে একটি কলসি নিয়ে ৩ কলস জল দিয়ে চিতার আগুন নিভিয়ে চিতাস্থল সাফ করলেন। সকলের পানি দেওয়া শেষে কলসিটা জল ভরে চিতার উপর রেখে ৮টি কড়ি ও একটি বাঁশের টুকরো কলসের নিকট পুঁতে রাখে আর সুন্দরী পেছনে ফিরে ইটের ঢিল মেরে কলস ভেঙ্গে বামদিক ঘুরে বয়স্কদের সামনে রেখে নদীতে ডুব দিতে যায়। সকলে ১ ডুব দিয়ে সুন্দরীর বাড়িতে এসে নিমপাতা দাঁতে কেটে ঘি, আগুন, নুড়ি পাথর স্পর্শ করলেন। এরপর শুরু হল সুন্দরীর অশৌচ কুশশয্যায় শয়ন, হবিষ্যান্ন ভোজন; উঠোনে তুলসী চারা পুঁতে প্রতিদিন এর তলায় তার বাবার উদ্দেশ্যে দুধ ও জল দেয়া। চতুর্থীতে ও দশমীতে ১০ খানা পূরকপিণ্ড দিলো। তারপর এভাবে ১২ দিন অশৌচ করে ১৩ দিনের দিন আসে শ্রাদ্ধ। এবার আরেকটা গভীর দ্বন্দ্বে পড়ল সবাই। অশৌচের পর শ্রাদ্ধের আগে তো মস্তক মুণ্ডনের প্রয়োজন। সবাই বলল সে মেয়ে মানুষ তাই মাথা কামানোর দরকার নেই, তৎপরিবর্তে সে নিজের সব চুলের আগা ধরে দুই আঙ্গুল পরিমাণ ছাঁটলেই হবে। তবে সুন্দরী বলল তার কোনও সমস্যা নেই, আমাদের গোত্রের শ্রাদ্ধবিধি অনুযায়ী যা করতে হয় তা আমি করব। সকলেই হতবাক হয়ে গেল, কিন্তু সে বলল প্লিজ আপনারা মেনে নিন আমি আমার বাবার জন্য কাজ করছি, তাই আমি আমার মাথা ন্যাড়া করব।
নাপিত ইতিমধ্যেই শ্মশানে উপস্থিত ছিল, সুন্দরী শীলের সামনে পিঠ ফিরিয়ে নতজানু হয়ে বসে পড়ে, সে তার শৈশবের দিনটির কথা ভাবছে, সে তার মুণ্ডন মনে মনে গ্রহণ করছে না, কিন্তু আজ তার বাবার জন্য সে মাথা কামাচ্ছে। সে কাঁদছে। এরই মাঝে শীল তার মাথায় পানি ঢালে। তার মাথাটি মোলায়েমভাবে ম্যাসাজ করে নেয়; এরপর নাপিত একটি নতুন ব্লেড ভেঙ্গে অর্ধেকটা রেজারে ঢুকিয়ে নিয়ে তার মাথার চাঁদি বরাবর কামাতে লাগলেন। তার লম্বা চুল তার কোলে ঝরে ঝরে পড়ছিল, সে তার মাথায় শীতলতা অনুভব করে। প্রায় কুড়ি মিনিট পর তার মাথা পুরোপুরি চাঁছা হয়ে গেছে, তার দীঘল চুল তার পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে আছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার মাথা স্পর্শ করে ও কাছের নদীতে স্নান করে আসে। অতঃপর তার প্রতিবেশীরা সুন্দরীকে একটি নতুন সাদা থান উপহার দিয়েছিল, শেষ অবধি সে একটি সাদা শাড়ি এবং নতুন টেকো চেহারা নিয়ে এলো এবং শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করল। তার বাড়ির প্রত্যেকে তার নিয়মানিষ্ঠা দেখে বিস্মিত। শ্রাদ্ধের পরে তার মনে এক অদ্ভুত ভাবান্তর হলো। ৪ মাস পর যখন তার চুল কানের লতি ঢেকে ফেলে তখন সে গিয়ে তার চুল কাটিয়ে আসে। তারপর তাকে আর কখনোই লম্বা চুলে দেখা যায়নি। সবসময় ছেলেদের মত ছোট বয়কাট চুলেই দেখা যায়।