ছােটো থেকেই রিয়ার বড় চুলের খুব শখ ছিল -ঠিক মায়ের মতাে। মা যখন কোমর ছাপানো চুলের বিনুনি বাঁধত, রিয়ার খুব ইচ্ছা হতাে তারও অমন চুল হবে। কিন্তু স্কুলে লম্বা চুল নিষেধ থাকায় প্রতি দু'মাস অন্তর মা ওর চুল কেটে দিত।
যেদিন চুল কাটা হতাে সেদিন রিয়া সারাদিন কান্নাকাটি করেই কাটাত। মা-বাবা অনেক বুঝিয়ে, আদর করে, গল্প বলে খাবার খাওয়াত। বাবা মেয়েদের মন ভােলাতে বেড়াতে নিয়ে যেত। এখন সেসব ছেলেমানুষির কথা মনে পড়লে রিয়ার হাসি পায়।
কলেজে ওঠার পর চুল লম্বা করার ছাড়প মিলেছিল। ঘন কালো এক আকাশ চুল নিয়ে রিয়া কলেজ যেত। সেই চুল যেমন অনেক মেয়ের মনে হিংসার উদ্রেক করত, তেমনি বহু ছেলের বুকে দোলাও লাগাত।
বিকাশ একদিন আর থাকতে না পেরে প্রেম নিবেদন করে বসল রিয়াকে। কলেজে সেটা তাদের দ্বিতীয় বর্ষ। দিনটা আজও মনে আছে রিয়ার - পয়লা বৈশাখ ছিল সেদিন। মায়ের লাল পেড়ে ঢাকাই পরেছিল রিয়া, লম্বা চুল বিনুনি বেঁধে একটা গােলাপ লাগিয়েছিল।
বিকাশের কথায় রিয়া হেসে বলেছিল - "বিয়ের পর যদি চুল কেটে ফেলি, তখন কি করবি?”
বিকাশ একটুও না ভেবে ফাজলামো মিশিয়ে বলেছিল - তোকে ধরে রেখে দেব আর চুল বেড়ে ওঠার অপেক্ষা করব।
সেদিনের ফাজলামি গভীর অনুরাগে পরিণত হয়েছিল তৃতীয় বর্ষের শেষে এসে, যখন দুজনের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল।
- "কখনো চুল কাটিসনা রিয়া। যখনই তুই চুল কাটবি, মনে করবি আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে যাচ্ছে।
"আবার ফাজলামো করছিস! ভাল করে মন দিয়ে MBA করে আয়।”
"তুই কখনও আমাকে seriously নিলি না রিয়া। একদিন এর মর্ম বুঝবি।” ছদ্ম অভিমানে বলেছিল বিকাশ।
এতদিন বাদে রিয়া ভাবে, সত্যি কি সবটাই মিথ্যে ছিল!? কিছুই কি ছিল না বিকাশের মনে? আর রিয়ার মনে?
"ম্যাডাম, এরপর আপনি আসুন!” পার্লারের মহিলার গলার আওয়াজে বাস্তবে ফিরে আসে রিয়া।
ধীর পায়ে চেয়ারে গিয়ে বসল। সামনে বিশাল একটা আয়না, যেটা দিয়ে পিছনের আয়না দেখা যাচ্ছে - আর দেখা যাচ্ছে রিয়ার মেঘের মতাে চুল.…
বিয়ের পর সন্দীপ বলতাে - প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস...তােমার চুলে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ
"যা:, রবিঠাকুরকে বিকৃত কোরাে না…!”
- বিকৃত কোথায় করলাম...এটাকে ধার করা বলে!" ফিচেল হাসি হেসেছিল সন্দীপ।
ইতিহাসে মাস্টার্স করে একটা স্কুলে চাকরী নিয়েছিল রিয়া। সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রিয়াকে পছন্দ করেন তার ভাইপাের জন্য। সন্দীপ software engineer, দেখতে-শুনতে ভালােই, বেশ মােটা অঙ্কের টাকা হাতে আসে মাস গেলে। উপরোন্ত সদ্য আমেরিকা থেকে ফিরেছে। রিয়া বা রিয়ার মা-বাবার আপত্তি করার কোনো কারণ তাে ছিলোই না, বরং মেয়ের জন্য এমন সােনার টুকরাে ছেলে পেয়ে তারা আর দ্বিতীয়বার ভাবেননি। এক মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায় রিয়া আর সন্দীপের।
নতুন সংসারে বেশ ভলােই মন বসছিল রিয়ার। বাড়িতে রিয়া, সন্দীপ, সন্দীপের মা আর কাজের মহিলা কমলা। রিয়া স্কুল সামলে টুকটাক রান্না শিখছিল শাশুড়ির কাছে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখল সন্দীপ ফিরে এসেছে, খুব টেনশনে।
- কি হয়েছে সন্দীপ?
- এইতো তুমি এসে গেছ। ফোন ধরছিলে না কেন? কতবার ফোন করছি!
রিয়ার মনে পড়ল, ক্লাস নিতে যাওয়ার আগে ফোনটা silent করেছিল। তারপর বেরোনোর তাড়াহুড়ােতে আর ঠিক করা হয়নি।
- “যাকগে...আমার বস আসছেন। বিয়েতে আসতে পারেননি, তাই আজ সন্ধ্যায় তােমার সাথে দেখা করতে আসবেন।dinner করে যাবেন। উনি আবার বাঙালী রান্না খেতে ভালোবাসেন।”
-"ও..আমি এখুনি মায়ের সাথে কথা বলছি...কি কি বানানাে যায় দেখি।”
সন্ধ্যা হতেই মি.শমিত গুপ্তা হাজির হলেন নিজের স্ত্রীকে নিয়ে। সন্ধ্যেটা ভালােই কাটল। মি. গুপ্তা রান্নার পাশাপাশি রিয়ার চুলের খুব প্রশংসা করলেন। এত সুন্দর চুল উনি নাকি কারোর দেখেননি। রিয়া সেদিন চুলটা খুলে রেখে একপাশে একগুচ্ছ রঙ্গন ফুল লাগিয়েছিল। একবার তাে মজা করে শমিত গুপ্তা বলেই ফেললেন, "সন্দীপ যদি রাজি থাকে তিনি বৌ পাল্টাপাল্টি করবেন।" রিয়া আরক্ত মুখে সন্দীপের দিকে তাকিয়েছিল - সন্দীপ খুব নির্বিকারভাবে বসের সাথে হাসছিল।
সেদিন রাতেই ঘটনাটা ঘটল। রিয়া কাজ সেরে আয়নার সামনে বসে চুল বাঁধছিল। সন্দীপ ঘরে ঢুকল - মদ্যপ অবস্থায়। বসকে সঙ্গ দিতে আজ একটু বেশী খেয়ে ফেলেছে। রিয়া কিছু বলেনি, কারণ ও জানে সন্দীপ খুব সংযত। এরকম আগেও এক-দুবার হয়েছে এবং সন্দীপ সােজা শুয়ে পড়েছে, রিয়াকে একটুও বিরক্ত না করে। কিন্তু যেদিন বিয়াকে অবাক করে দিয়ে অন্য এক সন্দীপ বেরিয়ে এসেছিল - “চুলের খুব বাহার হয়েছে না? দেখনদারি শুধু...আজ তােকে দেখাব ঐ চুল কি করে থাকে তোর!”
খুব নােংরা ভাষায় কথা বলছিল সন্দীপ আর তারপর রিয়ার চুল ধরে টেনে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিয়েছিল ওকে। রিয়া চিৎকার করতে পারেনি - প্রচন্ড বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিল। এরপর থেকে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে, যখনই কেউ রিয়ার চুলের সুখ্যাতি করে। অথচ অন্য সময় সন্দীপ একদম অন্য মানুষ। দুবার ক্ষমাও চেয়েছে। রিয়ার কাছে। রিয়া বাড়িতে জানাবে জানাবে করেও কিছু বলতে পারেনি। শাশুড়ি সব জেনে বুঝেও চুপ করে থাকতেন। একদিন রিয়াকে ডেকে কিছু পূজোর ফুল দিয়ে বলেন:
- ‘আমি দীপের জন্য পূজো দিয়েছি; এই ফুলটা ওর বালিশের তলায় রেখাে, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ একটু থেমে বললেন, 'আমি সবটা জানি...কিন্তু কি জানাে মা, সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে।'
রিয়া শাশুড়ির কথার তাৎপর্য বুঝতে পারেনা, এটাও বুঝতে পারে না এখানে রিয়ার কি দোষ! এরমধ্যেই রিয়ার গর্ভে আসে সন্দীপের সন্তান। সবাই খুব খুশী হয় এই সংবাদে। সন্দীপ নিজের আনন্দ ধরে রাখতে পারে না - চলো, কোথাও ঘুরে আসি। এইসময় মন ভালো থাকা খুব দরকার।
রিয়া একটু হলেও আশ্বস্ত হয়, হয়তো সন্তানের আগমন সন্দীপকে বদলে দেবে। বেশ ভালোই কাটছিল পুরীতে দিনগুলো। এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে গেলেও রিয়ার অনুরােধে আরও দুদিন থেকে যায় ওরা। সেদিনও সূর্যোদয় দেখে ফিরছিল…সন্দীপের হাত রিয়ার কোমরে জড়ানাে... দুজনেই দুজনের শরীরের ওম দিচ্ছিল…হঠাৎ
"আরে রিয়া না!! হ্যাঁ রিয়াই তো....”
বিকাশকে প্রথমে চিনতে পারেনি রিয়া। চাপদাড়ি আর রিমলেস চশমায় একদম অন্যরকম লাগছিল ওকে।
- '‘ম্যাডাম, চুলটা শ্যাম্পু করতে হবে। প্লিজ একটু wash basin-এ আসুন।’'
ঘাড়ে তােয়ালে জড়িয়ে মাথা নামিয়ে দেয় রিয়া। ঠান্ডা জলের স্রোত ভিজিয়ে দিতে থাকে রিয়ার মনের মেঘ।
"চলো সন্দীপদা, সমুদ্রে গা-টা ভিজিয়ে আসি।
দেখা হওয়ার পর থেকেই বিকাশ ওদের সঙ্গী। সন্দীপ শুধু জেনেছে ওরা একসাথে কলেজে পড়ত। এতদিন বাদে বিকাশকে দেখে রিয়াও কলেজের দিনে ফিরে গেছিল।
- "আমিও যাব।" রিয়ার আদুরে আবদার সন্দীপ ফেলতে পারে না। রিয়া খোঁপা বাঁধা চুলটা খুলে দেয়। পুরাে জলে না নেমে বসে পড়ে...সমুদ্র এসে ভেজাতে থাকে রিয়ার চুল।
- “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মতাে চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
বিকাশের মুখে জীবনানন্দ শুনে রিয়া এবং সন্দীপ দুজনেই অবাক। পরিস্থিতি হালকা করে রিয়া নিজেই বলে উঠলাে -
- "ফাজলামো করা এবার বন্ধ কর।” সবাই হেসে ওঠে একসাথে।
কিন্তু সন্দীপ যে এটা এত সহজে মেনে নেয়নি সেটা বাড়ি ফিরে বুঝতে পারে রিয়া। আকন্ঠ মদ্য পান করে এসেছিল সেদিন। রিয়ার লম্বা, মােটা বেণীটা গলায় পেঁচিয়ে ধরেছিল সর্বশক্তি দিয়ে ততক্ষণ, যতক্ষণ না রিয়া অজ্ঞান হয়ে নেতিয়ে পড়েছিল।
জ্ঞান এসেছিল হাসপাতালের ঠান্ডা ঘরে, আর তখনই অনুভব করে পেটে অসহ্য ব্যথা। পাশে মা আর শাশুড়ি দাঁড়িয়ে - দুজনের চোখেই জল।
- "ম্যাডাম, শুধু ট্রিম করব? নাকি length একটু ছােট করবেন?
- “ছােটো করব...”
দুদিন বাদে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরে রিয়া। সন্দীপ হাসপাতালে যায়নি। রিয়া যেদিন ফেরে, সেদিনও অনেক সকালে অফিস বেরিয়ে গেছিল। মাঝরাতে ফিরে ড্রয়িং রুমেই শুয়েছিল, রিয়ার ঘরে ঢােকেনি। সপ্তাহ খানেক পরে রিয়া কিছুটা সুস্থ বোধ করে...সন্দীপ ঘরে আসে - আমাকে ক্ষমা করাে রিয়া...আআআমি কিছু ভেবে...মানে.. আমি তাে বাচ্চা চেয়েছিলাম... কিন্তু ক্কি কি যে হলো...”
রিয়া মুখ ফিরিয়ে থাকে, জানলা দিয়ে রাস্তা দেখতে থাকে...
-"ম্যাডাম, আর কাটব?”
-“হ্যাঁ"
-"ম্যাম, এত সুন্দর চুল...সামনেটা layers কেটে নিতে পারেন
- "আপনাকে বললাম তো ছোট করে কাটতে
কাঁচি চলতে থাকে- রিয়ার চুলের সাথে মনেও। পার্লারের মেয়েটি অবিশ্বাস ভরা চোখ নিয়ে রিয়াকে দেখে "আরও ছােট করব ম্যাডাম?”
কোমর ছাপানাে চুল কাঁধে এসে দাঁড়িয়েছে।
- “আরও ছােট!” রিয়ার দৃষ্টি স্থির আয়নার দিকে।
আবার কাঁচি চলে। কাঁধের চুল ঘাড় অবধি। কাঁচি থামিয়ে রিয়ার দিকে তাকায় মেয়েটি “আরও ছােট!" রিয়ার দৃপ্ত কণ্ঠে পার্লারে থাকা বাকিরাও ঘুরে দেখে। মালিক ভদ্রমহিলা এগিয়ে আসেন “are you sure ma'am?”
রিয়া মাথা ঝাঁকায়।
"ছােট করে দিন...যতটা ছােট করা যায়...ও যেন আর চুল ধরতে না পারে...আমার বাচ্চাকে কেড়ে নিতে না পারে…" ডুকরে কেঁদে ওঠে রিয়া....!
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
কবিতা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশ।
গল্প অনুপ্রেরণা- টেলিভিশনে দেখা বিজ্ঞাপন।
[মমস্প্রেসোতে ২০১৯ সালের ১৭ই এপ্রিলে একই শিরোনামে পাবলিশ করা সংগৃহীত গল্প। লেখিকা রিতা সিনহা]
No comments:
Post a Comment