ছোটবেলায় কে জানি আমায় বলেছিল ..তোর দেখিস বিয়ে হবে না। নাকে এতো সর্দি আর চুল ছোট থাকলে বিয়ে হয় না। কোনো বৌয়ের নাকে সর্দি দেখেছিস? বৌয়েরা খোঁপা বাঁধে…তোর চুল কই ? এদিকে আমার নাক দিনরাত টইটম্বুর। সারা বছর নাক ঝড়ছে। স্নানের সময় শুধু একবার ফ্যেএএএৎ করতাম …ব্যাস, বাকী সময় নাকের জিনিস নাকেই রেখে দিতাম। ঠোঁট অব্দি গড়িয়ে আসতো আর নোনতা স্বাদ পেলেই হাত দিয়ে মুছে নিতাম। মায়েদের কেন যে এদিকে নজর ছিল না জানিনা। আর চুল তো জন্ম থেকেই চাইনিজ কাট। কানের লতি অব্দি চুল কাটা আর কপালের দিকটা যেন স্কেল বসিয়ে সমান করে কাটা। এটা বুঝি চাইনিজ কাট। মা চুল লম্বা করতেই দিতেন না। গ্রীষ্মের ছুটিতে ন্যাড়া আর শীত আসতে আসতে চাইনিজ।
বিয়ে হবে না শুনে দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল । বরাবরই মা হওয়ার বাসনা আমার। মায়েদের স্কুলে যেতে হয় না , সকাল সন্ধ্যে পড়তে বসতে হয়না, পরীক্ষা দিতে হয়না । একটু রাঁধো বাড়ো, ঘরদোর পরিষ্কার করো আর ঠাকুর দাও…এই তো মায়েদের কাজ। কি আরাম। স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম মায়ের সব কাজ শেষ…সামনের বারান্দায় আরাম করে বসে চালটাল বাছছেন আর কাকিমাদের সাথে গল্প করছেন। আমাকে দেখেই মা উঠে পড়তেন আর আমার সবচেয়ে খারাপ লাগা কাজটা করতেন…ভাত বেড়ে দিতেন। খাওয়া দাওয়া আমার অসহ্য লাগতো। কিন্তু নিস্তার নেই …খেতে তোমাকে হবেই তিনবেলা। নিজে কিন্তু প্রায়ই রাতে খাচ্ছেন না..কিন্তু আমার বেলায় ওটি হবার জো নেই। ভাবতাম আমি যখন মা হবো তখন খাবই না…কোনদিনও খাবো না। কেউ বকার থাকবে না বা জোর করে খাইয়ে দেওয়ারও থাকবে না..কি মজা। কিন্তু মা টা হবো কি করে ? বিয়েই তো হবে না শুনলাম ।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতাম…বিশেষ করে নাক আর চুলটা। নাক ভর্তি দেখে খুব কষ্ট হতো…হে ভগবান, তুমি একি করলে ? এতো সর্দি দিলে কেন ? দেখো এখন আমার বিয়ে হবে না। কাঁধ উঁচু করে চুল টেনে সামনে আনার চেষ্টা করতাম। সে তো মগডালে উঠে বসে আছে। দুদিন বাদে বাদেই মেপে দেখতাম কতটা লম্বা হলো। যেই কে সেই। মনে দুঃখ নিয়ে পড়তে বসতাম। পড়ায় মনে নেই… খাতায় , টেবিলে , বইয়ে , দেওয়ালে শুধু একটা মেয়ের ছবি আঁকতাম ..শাড়ী পরা , মস্ত একটা খোঁপা আর কপালে টিপ। নিজেকে ওরকম দেখতে চাই কিন্তু মায়ের জ্বালায় সেটি হবার নয়।
তারপর থেকে রাস্তাঘাটে, স্কুলে, আত্মীয়দের বাড়ীতে গেলে আমি শুধু খেয়াল করি মহিলাদের নাক আর চুল। হ্যাঁ, ঠিকই তো…কারো তো নাকে ইয়ে নেই আর চুল কি সুন্দর লম্বা। হয় খোঁপা করে রেখেছে নয়তো বিনুনি। হা ইশ্বর !!! এ তুমি কি করলে ? বিয়েবাড়ীতে গিয়েও আমার ঐ একই কাজ। নতুন বৌ সেজেগুজে খাটে বসে আছে। বৌ সুন্দর না বান্দর সেদিকে আমার নজর নেই। খাটের সামনে গিয়ে নীচে বসে পড়তাম। নাকের ফুটোর দিকে নজর। নতুন বৌ কি ভাবতো কে জানে..আমাকে কাছে ডেকে নিত আর সেই ফাঁকে ওড়নার নীচে চুলটা কেমন দেখে নিতাম আর হতাশ হতাম।
পরের গ্রীষ্মের ছুটি আসতেই আমার বুক ধুকপুকু করতে লাগলো..কি জানি কোন রবিবারে নাপিত আসে আর আমার লম্বা চুলের স্বপ্নে ক্ষুর চালায়। এক একটা রবিবার আসে আর আমার টেনশন বাড়ে। রবিবারে তো সকাল হলেই পেট ব্যাথা করছে বলে আমি বিছানায় শুয়ে থাকতাম। তারপর একদিন সেই দুঃস্বপ্নের রাত এলো…মা বাবাকে বললেন..কাল নিতাই নাপিতকে খবর দিও তো। পড়ার টেবিলে বসে আমি শুনতে পেলাম। মনে হলো বেঁচে থেকে আর কি করবো..যার বিয়ে হবে না তার আর কি জীবন ? সারাজীবন পড়াশোনা করার চেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া অনেক ভালো। তবে নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে একটা শেষ চেষ্টা করবো। বাবার সাথে আলোচনা করবো। রাতে খাওয়ার পর মা যখন রান্নাঘর গোছাচ্ছেন তখন বাবাকে একা পেয়ে বললাম…বাবা , চুল আমি কাটবো না। বাবা বই পড়তে পড়তে বললেন ..কেটো না। আমি তো অবাক। এত সহজে আমার জিৎ হয়ে গেল !!!! লাফিয়ে বাবার কোলে উঠে বললাম…সত্যি ? হ্যাঁ সত্যি । আমার যে কি আনন্দ হলো কি বলবো। বাবার কানে কানে চুল না কাটার কারণটা বললাম। বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। ওওওওও এই কারণে তুমি চুল কাটবে না ? আর সর্দি র ব্যাপারে কি ভেবেছ ? বললাম ..একটা আইডিয়া বের করেছি..রুমাল দিয়ে নাকটা ঢেকে রাখবো…কেউ টের পাবে না।
সেদিন ঘুমিয়ে পড়লাম নিশ্চিন্তে । স্বপ্নও দেখলাম বোধহয় … বেনারসী পরে, বড় একটা খোঁপা বেঁধে নাকটা রুমাল দিয়ে ঢেকে আমি খাটে বসে আছি আর সবাই এসে আমাকে দেখছে আর উপহার দিচ্ছে । সকাল হলো । মা ঘুম থেকে ডেকে তুললেন । ওঠো, নিতাইদাদা এসেছে..চুল নখ কেটে সোজা স্নানে চলে যাও। আমি তো চমকে উঠলাম ..সেকি , বাবা তো বললেন কেটো না। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে বাবার পড়ার ঘরে গেলাম। বাবা নেই । বাবা তো এসময় বাজারে যান। এখন কি হবে ? নিতাইদা তো ছোট জলচৌকিতে বসে ক্ষুর শানানো শুরু করে দিয়েছে। আমি মরিয়া হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে মাকে বললাম আমার পেট ব্যাথা করছে..পারছি না.. বলেই পেটে হাত দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লাম । মা রুটি বেলা বন্ধ করে হাত ধুয়ে চ্যাংদোলা করে আমায় নিয়ে নিতাইদার সামনে বসিয়ে দিলেন। আগে অ আ ক খ শেখো তারপর বিয়ের কথা ভাববে..বলে রান্নাঘরে চলে গেলেন। আমি পিঁড়িতে মাথা নিচু করে বসে আছি; আমার চুল আর আমার চোখের জল একসাথে মাটিতে পড়ে একাকার হয়ে গেল।
সেই আমার বিয়েও হলো..নাকের সর্দি যে কবে গায়েব হলো জানিনা..চুলও লম্বা হলো..মা ও হলাম কিন্তু টের পেলাম মা হওয়া কি যে জ্বালা। মায়ের কাজগুলো কি যে বাজে কাজ । রান্না থেকে রেহাই নেই, ঘরদোরের খেয়াল রাখা, ঘরে বাইরে কাজ করা, উফফ। সীমানার সেনাদের মতো মায়েরা পরিবারের অতন্দ্র প্রহরী …ওরে বাবা কি কঠিন কাজ । আর ভাবতাম মা হয়ে গেলে খাওয়া দাওয়াটা পুরো ছেড়ে দেবো। ওওও হরি …এখন ডাক্তার হাতে পায়ে ধরেও আমার খাওয়া কমাতে পারছে না।
[২২ জানুয়ারি, ২০১৮ সনে খেলাঘরওয়েবে বিজয়া পুরকায়স্থের লেখা]
বিয়ে হবে না শুনে দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল । বরাবরই মা হওয়ার বাসনা আমার। মায়েদের স্কুলে যেতে হয় না , সকাল সন্ধ্যে পড়তে বসতে হয়না, পরীক্ষা দিতে হয়না । একটু রাঁধো বাড়ো, ঘরদোর পরিষ্কার করো আর ঠাকুর দাও…এই তো মায়েদের কাজ। কি আরাম। স্কুল থেকে ফিরে দেখতাম মায়ের সব কাজ শেষ…সামনের বারান্দায় আরাম করে বসে চালটাল বাছছেন আর কাকিমাদের সাথে গল্প করছেন। আমাকে দেখেই মা উঠে পড়তেন আর আমার সবচেয়ে খারাপ লাগা কাজটা করতেন…ভাত বেড়ে দিতেন। খাওয়া দাওয়া আমার অসহ্য লাগতো। কিন্তু নিস্তার নেই …খেতে তোমাকে হবেই তিনবেলা। নিজে কিন্তু প্রায়ই রাতে খাচ্ছেন না..কিন্তু আমার বেলায় ওটি হবার জো নেই। ভাবতাম আমি যখন মা হবো তখন খাবই না…কোনদিনও খাবো না। কেউ বকার থাকবে না বা জোর করে খাইয়ে দেওয়ারও থাকবে না..কি মজা। কিন্তু মা টা হবো কি করে ? বিয়েই তো হবে না শুনলাম ।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতাম…বিশেষ করে নাক আর চুলটা। নাক ভর্তি দেখে খুব কষ্ট হতো…হে ভগবান, তুমি একি করলে ? এতো সর্দি দিলে কেন ? দেখো এখন আমার বিয়ে হবে না। কাঁধ উঁচু করে চুল টেনে সামনে আনার চেষ্টা করতাম। সে তো মগডালে উঠে বসে আছে। দুদিন বাদে বাদেই মেপে দেখতাম কতটা লম্বা হলো। যেই কে সেই। মনে দুঃখ নিয়ে পড়তে বসতাম। পড়ায় মনে নেই… খাতায় , টেবিলে , বইয়ে , দেওয়ালে শুধু একটা মেয়ের ছবি আঁকতাম ..শাড়ী পরা , মস্ত একটা খোঁপা আর কপালে টিপ। নিজেকে ওরকম দেখতে চাই কিন্তু মায়ের জ্বালায় সেটি হবার নয়।
পরের গ্রীষ্মের ছুটি আসতেই আমার বুক ধুকপুকু করতে লাগলো..কি জানি কোন রবিবারে নাপিত আসে আর আমার লম্বা চুলের স্বপ্নে ক্ষুর চালায়। এক একটা রবিবার আসে আর আমার টেনশন বাড়ে। রবিবারে তো সকাল হলেই পেট ব্যাথা করছে বলে আমি বিছানায় শুয়ে থাকতাম। তারপর একদিন সেই দুঃস্বপ্নের রাত এলো…মা বাবাকে বললেন..কাল নিতাই নাপিতকে খবর দিও তো। পড়ার টেবিলে বসে আমি শুনতে পেলাম। মনে হলো বেঁচে থেকে আর কি করবো..যার বিয়ে হবে না তার আর কি জীবন ? সারাজীবন পড়াশোনা করার চেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া অনেক ভালো। তবে নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে একটা শেষ চেষ্টা করবো। বাবার সাথে আলোচনা করবো। রাতে খাওয়ার পর মা যখন রান্নাঘর গোছাচ্ছেন তখন বাবাকে একা পেয়ে বললাম…বাবা , চুল আমি কাটবো না। বাবা বই পড়তে পড়তে বললেন ..কেটো না। আমি তো অবাক। এত সহজে আমার জিৎ হয়ে গেল !!!! লাফিয়ে বাবার কোলে উঠে বললাম…সত্যি ? হ্যাঁ সত্যি । আমার যে কি আনন্দ হলো কি বলবো। বাবার কানে কানে চুল না কাটার কারণটা বললাম। বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। ওওওওও এই কারণে তুমি চুল কাটবে না ? আর সর্দি র ব্যাপারে কি ভেবেছ ? বললাম ..একটা আইডিয়া বের করেছি..রুমাল দিয়ে নাকটা ঢেকে রাখবো…কেউ টের পাবে না।
সেদিন ঘুমিয়ে পড়লাম নিশ্চিন্তে । স্বপ্নও দেখলাম বোধহয় … বেনারসী পরে, বড় একটা খোঁপা বেঁধে নাকটা রুমাল দিয়ে ঢেকে আমি খাটে বসে আছি আর সবাই এসে আমাকে দেখছে আর উপহার দিচ্ছে । সকাল হলো । মা ঘুম থেকে ডেকে তুললেন । ওঠো, নিতাইদাদা এসেছে..চুল নখ কেটে সোজা স্নানে চলে যাও। আমি তো চমকে উঠলাম ..সেকি , বাবা তো বললেন কেটো না। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে বাবার পড়ার ঘরে গেলাম। বাবা নেই । বাবা তো এসময় বাজারে যান। এখন কি হবে ? নিতাইদা তো ছোট জলচৌকিতে বসে ক্ষুর শানানো শুরু করে দিয়েছে। আমি মরিয়া হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে মাকে বললাম আমার পেট ব্যাথা করছে..পারছি না.. বলেই পেটে হাত দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লাম । মা রুটি বেলা বন্ধ করে হাত ধুয়ে চ্যাংদোলা করে আমায় নিয়ে নিতাইদার সামনে বসিয়ে দিলেন। আগে অ আ ক খ শেখো তারপর বিয়ের কথা ভাববে..বলে রান্নাঘরে চলে গেলেন। আমি পিঁড়িতে মাথা নিচু করে বসে আছি; আমার চুল আর আমার চোখের জল একসাথে মাটিতে পড়ে একাকার হয়ে গেল।
সেই আমার বিয়েও হলো..নাকের সর্দি যে কবে গায়েব হলো জানিনা..চুলও লম্বা হলো..মা ও হলাম কিন্তু টের পেলাম মা হওয়া কি যে জ্বালা। মায়ের কাজগুলো কি যে বাজে কাজ । রান্না থেকে রেহাই নেই, ঘরদোরের খেয়াল রাখা, ঘরে বাইরে কাজ করা, উফফ। সীমানার সেনাদের মতো মায়েরা পরিবারের অতন্দ্র প্রহরী …ওরে বাবা কি কঠিন কাজ । আর ভাবতাম মা হয়ে গেলে খাওয়া দাওয়াটা পুরো ছেড়ে দেবো। ওওও হরি …এখন ডাক্তার হাতে পায়ে ধরেও আমার খাওয়া কমাতে পারছে না।
[২২ জানুয়ারি, ২০১৮ সনে খেলাঘরওয়েবে বিজয়া পুরকায়স্থের লেখা]