Friday, July 3, 2015

কুচ বরণ মেয়ে তার মেঘ বরণ চুল (অন্তিম খণ্ড)

লিখেছেন : সন্ধ্যা প্রদীপ
জান্নাতের মন খারাপ। ভীষণ ভীষণ খারাপ। বাসা থেকে জরুরী তলব করেছে যাওয়ার জন্য। কোন ছেলেপক্ষ নাকি তাকে পছন্দ করেছে। দুপক্ষের কথা চলছে। সব ঠিক থাকলে তাকে আংটি পড়িয়ে এনগেজমেন্ট করে যাবে। জান্নাত আগে থেকেই জানত তাকে এভাবেই হুট করে যে কারো গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে কিন্ত সে যদি শুধু আর আটটা মাস সময় পেত তাহলেই ফাইনাল পরীক্ষাটা দিয়ে ফেলতে পারত। সে ভেবে পায় না কোন ছেলেপক্ষ তার ছোট চুল দেখেও বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। সে ভাবে আর একবার ন্যাড়া করে ফেলবে কিন্ত বোঝে এতে আর কোনো লাভ হবে না।

বাসায় গিয়ে জান্নাত বোঝে বিয়েটা এবার আর ঠেকানো যাবে না। বাসার সবাই রাজি এমনকি ছোট চাচুমনিও বিয়ের পক্ষে। ছেলে নাকি ভাল সরকারি চাকরি করে এছাড়া দেখতেও সুদর্শন। সে যাই হোক একমাত্র সেই বিমর্ষ মনে বসে থাকে আর দোয়া করে যেন ছেলেটি একটু উদার মনের হয়। সে যেন জান্নাতকে পড়ালেখা শেষ করতে দেয়। পরদিন ছেলেপক্ষের সামনে সে কলের পুতুলের মত নির্জীব হয়ে বসে থাকে। একহাত ঘোমটার নিচ দিয়ে সে কারো দিকে তাকিয়েও দেখে না। শুধু তার ভীষন কান্না পেতে থাকে। এর মাঝে একজন মুরুব্বি তার হাতে আংটি পড়িয়ে দেয়। কথা হয় একবছর পরে বিয়ে হবে।একথা শুনে সে ভীষন অবাক হলেও হাফ ছেড়ে বাঁচে।

আলাপ করার জন্য যখন ছেলে ও মেয়েকে আলাদা ঘরে বসান হয় তখন প্রথমেই ছেলেটি তার বিশাল ঘোমটা সরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, সেদিন ডিনারে আসনি কেন? আমি পুরোটা সময় তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। জান্নাতের মনে তখন বহুমুখী আবেগের প্লাবন। আনন্দ অশ্রুটুকু দেখতে দেবেনা বলেই সে মুখ তুলে তাকাতে পারেনা।

আজ জান্নাতের শেষ পরীক্ষা। সে আর নিতু হাত ধরাধরি করে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আসে। জান্নাতের ঘন চুলের ঝর্না এখন কাঁধ ছুঁয়ে পিঠে এসে পড়ে। একবছর অনেক সময়। আর ছয় মাস পর জান্নাতের বিয়ে। ছয়মাসে এই চুলের ঝর্ণা কোমর ছাড়িয়ে যাবে। জান্নাতের মনের সেই ছোট্ট মোহের চারাটি এখন অনেক বড় হয়েছে, জান্নাত জানে একদিন তা আরো বিস্তৃত হয়ে আকাশ ছোঁবে আর কোনো একসময় মহাকাশ। 



{গল্পটা ২০১৫ সালের ৩রা জুলাই রাত ৮ঃ৫১ মিনিটে সামহোয়্যারইন ব্লগে তিনটি খণ্ডই একযোগে এই নামেই প্রকাশিত হয়। ওখান থেকেই গল্পটা সংগ্রহ করে ৩টি খণ্ড আলাদা আলাদা পোস্ট করলাম।}

কুচ বরণ মেয়ে তার মেঘ বরণ চুল (২য় খণ্ড)

লিখেছেন : সন্ধ্যা প্রদীপ

এমন সেলিব্রিটি ইমেজ নিয়ে তার দিনগুলো ভালই কাটছিল এমন সময় ডিপার্টমেণ্টের একটি ব্যাচের নবীনবরন উপলক্ষে অনেক বড় অনুষ্ঠান করার প্রস্তুতি শুরু হলো। সব ব্যাচ অংশ নেবে এতে। সে যেন এক আনন্দ মেলা। প্রতি দিন বিকেলে রিহার্সেল হয়,আড্ডা হয় আরো কত কিছু। একটা ফ্যাশান শো আর একটি যুগল নাচ। পার্টনার তিন ব্যাচ সিনিয়র রিয়াদ ভাই। রিহার্সাল চলতে লাগল পুরোদমে। রিয়াদ ছেলে হিসাবে বেশ হ্যান্ডসাম, জান্নাত তাকে আগেও অনেকবার দেখেছে কিন্ত এই প্রথম বার কাছে থেকে ভাল করে লক্ষ্য করল। কি চমৎকার তার কথা বলার ভঙ্গি আর কি চমৎকার তার ব্যাক্তিত্ব। এই রিহার্সালের মধ্যে দিয়ে সবার সাথে সবার অনেক খাতির হয়ে গিয়েছে। জান্নাত যদিও অন্য সবার ব্যাপারে খুব সাবলীল কিন্ত রিয়াদ ভাইর কাছে তার কেমন যেন একটা সঙ্কোচ রয়েই গেল। যদিও সেটা শুধু সাধারন ক্ষেত্রে, রিহার্সালে তারা দুজনেই খুব ভাল করতে লাগল। তার ছোট চুল তাই তাদের জন্য ঠিক করা হয়েছে ওয়েষ্টার্ন গান। তাদের বোঝাপড়া এক্ষেত্রে এত ভাল হয়েছিল যে অন্যরা তাদের কাজ ফেলে ওদের রিহার্সাল দেখত।

আজকাল জান্নাতকে কেমন যেন একটা নেশায় পেয়ে বসেছে। সারাদিন বিকেলের জন্য মন উতলা হয়ে থাকে। আর বিকেল চলে গেলেও স্মৃতিগুলো পিছু ছাড়তে চায় না। সে বার বার নিজেকে আয়নায় দেখে আর নিজের মনেই হাসে। এর মাঝেই একদিন সে রিয়াদ আর তার বন্ধুদের কিছু আলোচনা শুনে ফেললো। মাস্টার্সের ব্যাচের কিছু ছাত্রছাত্রী ডিপার্টমেন্টের ক্যান্টিনের বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল ভেতরের ঘরে যে সে আছে তারা সেটা খেয়াল করেনি তাই এটা সেটা বলতে বলতে একজন হঠাৎ বলে ফেললো– আমি যে নাটকটা লিখেছি তাতে রিয়াদ কে নায়ক করবো ভাবছি কিন্ত মনমতো নায়িকা পাচ্ছিনা। অন্য একজন বলল কেন ওর পার্টনারকে নিয়ে নে। আগেরজন বললো, নাহ! ঐ মেয়ের তো চুল নেই গ্রাম ভিত্তিক কাহিনীতে একদম মানাবে না। অন্য আর একজন বললো, মেয়েটাকে কিন্ত আমাদের রিয়াদের সাথে খুব মানায়, পার্টনারশিপটা পার্মানেন্ট করে নে, কি বলিস রিয়াদ? তখন রিয়াদ বিব্রত গলায় বলে উঠল, আরেহ কি যে বলিস তোরা।বাজে কথা বলিস না। সবার একচোট হাসির মাঝেই একজন মেয়ে বলে উঠল, ওখানেও তো একই সমস্যা, চুল! আমাদের রিয়াদ দেখতে হাইফাই হলে কি হবে পছন্দ একদম কবরী-ববিতার যুগের মত ঘন কালো কেশবতী কন্যা। বয়কাট দিয়ে কি আর ওর মন ভরে? সবাই আর একচোট হেসে উঠল।

এইসব আলোচনা শুনে জান্নাতের গালদুটো লাল হয়ে উঠল। সে মনে মনে ভাবল, ও তাহলে আমাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আমার চুল নিয়ে মজা করা হচ্ছে?রূমে ফিরে আয়নাতে নিজের চেহারা দেখে চুল কাটার পর প্রথমবার তার আফসোস হলো। বারবার মনে হতে লাগল, ইশ যদি চুলগুলো এভাবে কেটে না ফেলতাম তবে কেউ আর আমাকে নিয়ে মজা করতে পারত না। একটা দিন তার এইসব ভাবনাতেই কেটে গেল, এমনকি সে ক্লাসে বা রিহার্সেলেও গেল না। তারপর হঠাৎ তার মনে হলো আচ্ছা, আমি তো আমিই।আমার চুল বা অন্য কিছু তো আমি নই শুধু আমার দেহের একটা অংশ। সেটা সাময়িকভাবে না থাকতে পারে কিন্ত আমি তো সম্পূর্নই রয়েছি তার সামনে। আমার সাথে মিশে আমাকে চেনার ও কাছ থেকে জানার সুযোগ সে পাচ্ছে। এতকিছুর পর যদি মানুষ হিসাবে আমাকে তার ভাল লাগে তবে সে নিশ্চয় চুলের মত তুচ্ছ কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে না। আর যদি কারো কাছে আমার চেয়ে আমার চুল বড় হয়ে দেখা দেয় তো সেই মানুষকে আমার দরকার নেই। নিজের এভাবে বুঝিয়ে জান্নাত মনটাকে স্থির করে।

পরদিন থেকে সে আবার রিহার্সেলে যাওয়া শুরু করে। রিয়াদের সেই বন্ধু অবশেষে নাটকের নায়িকা হওয়ার জন্য তাকে প্রস্তাব দেয়, অবশ্য তার জন্য একটা পরচুলা আনা হবে বলে ঠিক করা হয়। জান্নাত ভেবেছিল না করে দেবে কিন্ত হায়রে মানুষের মন! মোহ থেকে বের হওয়া কি এত সোজা? আর কিছু না হোক রিয়াদ ভাইয়ের একটু কাছে থাকা, তার গায়ের পারফিউম আর সিগারেটের ধোঁয়া মিশ্রিত পুরুষ পুরুষ গন্ধ, তার কথা শোনা। এটুকু ভাললাগার জন্যেই সে প্রস্তাব ছাড়তে পারেনা। একমাসের রিহার্সেলের পর দারুন একটা প্রোগ্রাম হয়। জান্নাত অনেক প্রশংসা পায়। তারপর দিন কাটতে থাকে আপন গতিতে। পরীক্ষা শেষে রিয়াদের বিদায়ের সময় হয়ে আসে। তারা পরিচিতদের নিয়ে একটা বিদায়ী ডিনারের আয়োজন করে কিন্ত বিশেষ নিমন্ত্রন সত্ত্বেও জান্নাত সেখানে যায় না। কেন যায় না তা সে নিজেও জানে না। বরং সেদিন সে পার্লারে গিয়ে ২য় বারের মত ন্যাড়া করে আসে।

এরপর কেটে গেছে আরো একটা বছর। জান্নাত এবছর অনার্স ফাইনাল দেবে। বহু ব্যস্ততার মাঝে তার দিন কাটে। কখনও হঠাত করে তার রিয়াদের কথা মনে হয় খুব অল্প সময়ের জন্য। আসলে মোহ অনেকটা বৃক্ষের মত, তার বীজ বপনের পর যত্ন করলে তবেই চারা বের হয় আর একদিন তা বিশাল আকার নেয়। জান্নাতের মনে মোহের বীজ বপন হয়েছিল সেইসব দিনে, চারাও গজিয়েছিল কিন্ত সে বুদ্ধিমান তাই হাওয়া পানি দিয়ে সেটাকে আর বড় হতে দেয়নি। নিজের জীবনে চেয়ে না পাওয়ার বেদনার কূপ খনন করেনি। শুধু মাঝে মাঝে হঠাৎ একটু ফিরে তাকায় মোহের চারাটির দিকে। ব্যস এ পর্যন্তই। সে শুধু একটা হিসাব মেলাতে পারেনা। নাটকের দিন স্টেজে ওঠার আগে লাল-সবুজ গ্রামীনচেক শাড়ি, রেশমি চুড়ি পড়ে যখন সে রিয়াদের সামনে যায় তখন রিয়াদের চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি ছিল।নিজের স্বপ্ন পুরুষের চোখে তীব্র মোহ আর মুগ্ধতার প্রথম দৃষ্টি যে দেখেছে সেই নারীমাত্রই জানে সে দৃষ্টি কেমন। জান্নাত হিসাব মেলাতে পারেনা, সেই দৃষ্টির কারণ কি সে না তার লম্বা নকল চুল সে তা আজও বোঝে না।

কুচ বরণ মেয়ে তার মেঘ বরণ চুল (১ম খণ্ড)

লিখেছেন : সন্ধ্যা প্রদীপ

উইমেন্স বিউটি পার্লারের বারান্দায় নিতু চুপচাপ বিমর্ষ চেহারা নিয়ে বসে ছিল। জান্নাত যখন ভেতর থেকে কাজ সেরে তার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন আক্ষরিক অর্থেই নিতুর চোখ প্রমান সাইজ রসগোল্লার মত হয়ে গেল। সে কিছুক্ষণ কিছু বলার চেষ্টা করে না বলতে পেরে প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল এবং বলেই ফেললো, তুই শেষ পর্যন্ত সব শেষ করেই দিলি? জান্নাতের মুখে তখন এক বিচিত্র হাসি, তাতে কিছুটা কৌতুক কিছুটা বিদ্রুপ আর হয়ত একটু সহানুভূতি। সে দুহাতে নিতুকে জড়িয়ে ধরে বললো, রাগ করিস না লক্ষ্মীটি। তুই তো জানিসই কেন চুলগুলো কাটা জরুরী ছিল। নিতু নিজেকে জান্নাতের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রায় কান্নার স্বরে বললো তাই বলে তুই একেবারে টাক করে ফেলবি? যদি একটা বয়কাট দিতি তাহলেও এত খারাপ লাগতো না, তোর এত সুন্দর চুল!একটু মায়াও লাগলো না সব কেটে ফেলতে? আসলে নিতু জান্নাতের প্রাণের বন্ধু তাই এই চুল কাটার অভিযানে নিতুকে সে সাথে এনেছে। যদিও সে এব্যাপারে মোটেও রাজি ছিল না তাই পার্লারের মেয়েটা যখন এত্তবড় কাঁচি দিয়ে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে তার ঘন কালো চুলের বোঝা কেটে দিচ্ছিল তখন নিতু আর সহ্য করতে না পেরে বাইরের বারান্দায় এসে বসেছে। পার্লারের মেয়েটারও মনে হয় এত সুন্দর চুল এভাবে কাটতে মন চাইছিল না তাই সে বার বার জিজ্ঞাসা করছিল আসলেই সে মাথা ন্যাড়া করবে কিনা। সেখানে উপস্থিত সবাই ওকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছিল কিন্ত জান্নাতের এক জিদ।

নিতুর অভিযোগ জান্নাত মোটেও গায়ে মাখল না বরং নিজের ন্যাড়া মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, দেখ আমার খুলির সাইজ দেখার এমন সুযোগ আর পাবি কখনো? আমার মাথাটা বেশ সুন্দর না? ন্যাড়া মাথাতেও আমাকে বেশ গর্জিয়াস লাগছে, তাইনা? নিতু মুখ বাঁকিয়ে বললো আর ঢং করিস না। তোকে দেখতে প্রমাণ সাইজ কাতল মাছের মত লাগছে। রোনালদো ও তোকে দেখলে চমকে যাবে। জান্নাত একটা অট্টহাসি দিয়ে ব্যাগ থেকে রঙ্গিন একটা স্কার্ফ বের করে মাথায় জড়িয়ে নিল তারপর বলল, চল আজ এই বিশেষ দিনে সঙ্গদানের জন্য তোকে গ্রিল চিকেন খাওয়াই। এই বলে সে নিতুকে টানতে টানতে একটা রেস্টুরেন্টের দিকে নিয়ে গেল। সন্ধ্যায় হলে ফিরে বাথরুমে গোসল করতে ঢুকে সে নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ কেঁদে নিলো। তার চুলগুলো তার নিজেরও ভীষন প্রিয় ছিল। কিন্ত কি করা তার সিদ্ধান্তে সে অটল।

ছোটবেলা থেকেই জান্নাত বেশ রূপসী।মাঝারি উচ্চতার, মাঝারি স্বাস্থ্যের জান্নাতকে দেখতে অনেকটা পুতুল পুতুল লাগে। ফর্সা গায়ের রং, ফোলা ফোলা গালে গোলাপী আভা। তার মিষ্টি চেহারাটাকে ফ্রেম করেছে কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া এক রাশ কুচকুচে কালো চুল। কিন্ত এই মুগ্ধ করা রূপই তার জীবনের সমস্ত দুঃশ্চিন্তার কারণ। তাদের যৌথ পরিবার তাই সবাই একবাড়িতেই থাকে। জান্নাতের বাবা বেশ পুরোনো চিন্তার লোক। জান্নাতের মনে হয় তার বাবার জীবনের একটাই লক্ষ্য আর সেটা হচ্ছে জান্নাতের বিয়ে দেয়া। আর পাড়ার মানুষজনও যেমন, সে যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন পাড়ার এক চাচি তার ভাইয়ের সাথে জান্নাতের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে। ব্যস, সেই থেকেই বাবার মাথায় ঢুকেছে মেয়ের বিয়ের পোকা। যদিও তিনি মেয়েকে খুবই ভালবাসেন, সব আবদার রাখেন কিন্তু এই পোকা তার মাথা থেকে বের করা অসম্ভব।বড় চাচুমনিও জান্নাত কে খুবই আদর করেন কিন্ত তারও এক অভিমত। কেউ যদি বিয়ের কথা পাড়ে অমনি দুই ভাই মিলে লেগে যায় খোঁজখবর করতে। আপত্তি করলেই শুরু হয় লেকচার, এই বাড়ির কোন মেয়ের কত কচি বয়সে বিয়ে হয়েছিল; মা চাচীরা কত কম বয়সে বালিকাবধূ হয়ে এই বাড়িতে এসেছিল ইত্যাদি।

বড় চাচুমনি তো তার মেয়ে ফারিহা আপুকে কলেজ শেষ হতে না হতেই বিয়ে দিয়ে দিল। ফারিহার গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা। চাচুর এক কথা অসুন্দর মেয়ে ঘরে জিইয়ে রাখার কোনো মানে হয় না, ইঞ্জিনিয়ার পাত্র পাওয়া গেছে এখনি বিয়ে দেয়া উচিৎ। আপু কত মন খারাপ করল, কত কাঁদল তবু কেউ কথা শুনল না। অথচ আপু পড়ালেখায় কত ভাল ছিল, জান্নাতের চেয়েও ভাল। নির্ঘাত সে ঢাকা ভার্সিটিতে ফাটাফাটি একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে পারত। কিন্ত বিয়ের পরে তার আর পড়া হল না, দুবছরের মধ্যে বাচ্চা হয়ে গেল তাই স্থানীয় কলেজে ভর্তি হয়েও শেষে ছেড়ে দিতে হলো। জান্নাতের ক্ষেত্রে চাচুর যুক্তি হচ্ছে সুন্দর মেয়ে বেশি দিন ঘরে রাখতে হয় না। কি অদ্ভুত যুক্তি!

জান্নাতের তার পরিবারের এইসব চিন্তাই অসহ্য লাগে। মা-চাচিও যেন কেমন, হ্যাঁও বলেনা নাও বলেনা। একমাত্র ছোট চাচুমনি তাকে একটু সাপোর্ট দেয় কিন্ত বাবাদের ভয়ে সেও বেশি কিছু করতে পারেনা। জান্নাতের এসএসসি পরীক্ষার পর তো তার বাবা এক মোল্লার সাথে তার বিয়ে প্রায় দিয়েই ফেলেছিল। জান্নাতের কান্না দেখে ছোটচাচু যদি গোপনে নাবালিকা বিয়ের অপরাধে পুলিশের ভয় দেখিয়ে ঐ পার্টিকে না ভাগাতো তাহলে তার আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হত না। জান্নাত পিওর হাউসওয়াইফ হওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেনা। তার জীবনে কত্ত স্বপ্ন! বাড়িতে থাকলে মা-চাচিদের জীবন দেখলে তার অবশ্য খারাপ বলে মনে হয় না। সবাইকে দেখেশুনে রাখা, সবার যত্ন করা, বাচ্চাদের মানুষ করা সব মিলিয়ে কেমন একটা স্নিগ্ধ মায়া আছে তাদের জীবনে। কিন্ত জান্নাত নিজের জীবন থেকে আরো বেশি কিছু চায়। কতকিছু জানার আছে, দেখার আর শেখার আছে।তার ইচ্ছা সে অনেক পড়ালেখা করবে তারপর একটা ভাল চাকরি করবে। তখন সে যখন যা ইচ্ছা কিনতে পারবে। পরিবারের সবাইকে এটা সেটা কিনে দিতে পারবে, আর তার খুব ইচ্ছা পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে। তবে সবচেয়ে বড় হচ্ছে স্বাধীন আর স্বাবলম্বী হওয়া। এসবের জন্য তো তাকে মন দিয়ে পড়ালেখা করতেই হবে।

জান্নাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে প্রায় পাঁচ মাস হতে চলল। গরমের ছুটি শুরু হয়েছে এবার বাড়ি যাওয়ার পালা কিন্ত ছোট ভাইয়ের কাছে সে শুনেছে বাবা আবার পাগলামি শুরু করেছে জান্নাত বাড়িতে গেলেই ছেলেপক্ষ তাকে দেখতে আসবে। অনেক ভেবে তাই সে ঠিক করেছে যে নিজের চুল কেটে ফেলবে। এবার তো আর বয়সের অযুহাত দিয়ে ঠেকাতে পারবে না কিন্ত চুলহীন কোনো মেয়েকে নির্ঘাত ছেলে পক্ষ পছন্দ করবে না। তার এই প্রস্তাব শুনে বান্ধবীরা সবাই একযোগে আর্তনাদ করে উঠেছিল। তখন জান্নাত বলেছিল, তোরা কি চাস আমাকে কোনো হুজুরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিক আর সমস্ত জীবন আমাকে পর্দাঘেরা বাড়ির মধ্যে কাটাতে হোক। নিশাত বলেছিল, কিন্ত তুই চুল কাটলে বাসার সবাই বকবে না? জান্নাত বলেছিল তা বকবে কিন্ত কিছু একটা বলে ম্যানেজ করা যাবে আশা করি। সবাই আমাকে অনেক ভালবাসে কিন্ত যদি শুধু এই বিয়ের পাগলামিটা না করত! বর্ষা তার স্বভাবসুলভ ঢংমেশানো স্বরে বলেছিল, ইশ তুই চাস না কিন্ত তোর বাবা মা কি সুন্দর তোর বিয়ে দিতে চায়। আমি বিয়ে করতে চাই কিন্ত আমার বাবা মা একবারও সে কথা বলে না। তার কথা শুনে সবাই একচোট হেসেছিল।

শেষ পর্যন্ত জান্নাতের ইচ্ছে পূরণ হলো।বাসায় যাওয়ার পর তার ন্যাড়া মাথা দেখে সবাই আঁতকে উঠল, জান্নাতের মা তো প্রায় মূর্ছা যায় এমন অবস্থা। সবাই যখন জানতে চাইলো কেন এমন হল তখন সে সরল মুখ করে বলেছে, তোমরা তো জান না হলের গণরুমে কত তেলাপোকা। রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম তেলাপোকাতে জায়গায় জায়গায় চুল এমন ভাবে কেটেছে যে শেষে চুল ন্যাড়া করতে হলো। আরো দুজন মেয়ের এমন ন্যাড়া করতে হয়েছে। নইলে কি আমার এমন সুন্দর চুল আমি ন্যাড়া করি? যতই আজব হোক এমন অকাট্য যুক্তি না মেনে আর উপায় কি? তাই বাসার লোক শান্ত হলো, বিয়ের আপদও বিদায় হলো। দিন যায়, জান্নাতের চুল বড় হয়ে ঘাড় ছেয়ে পড়ে কিন্ত জান্নাত প্রতিবার বাড়ি যাওয়ার আগে ছেলেদের মত করে চুল ছেঁটে ফেলে। ছোট চুলেও জান্নাতের মুখের মিষ্টতা ম্লান হয় না কিন্ত ছেলের মায়ের মেয়ের চুল দেখে পছন্দ হয় না তাই বিয়ের কথাগুলো আগায় না। এভাবেই দুটি বছর কেটে গেল। জান্নাতের পড়ালেখার খাতিরে চুল বিসর্জন দেয়ার কাহিনী বান্ধবীদের মুখ থেকে অনেকেই জেনে গিয়েছে। এইজন্য সমস্ত হলে তাকে সবাই বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে। জুনিয়রদের কাছে তো সে রীতিমত বিদ্রোহী নারীত্বের প্রতিমূর্তি।

গ্রামীণ নাপিত~আনন্দ (শেষার্ধ)

"আহা…ঠিক আছে…" তিনি বললেন যখন আমি তার বাক্সের দিকে অনুসন্ধানের দৃষ্টিতে তাকালাম তার কাছে কোন ধরনের রেজার আছে তা দেখতে। সৌভাগ্যবশত ...