লিখেছেন : সন্ধ্যা প্রদীপ
উইমেন্স বিউটি পার্লারের বারান্দায় নিতু চুপচাপ বিমর্ষ চেহারা নিয়ে বসে ছিল। জান্নাত যখন ভেতর থেকে কাজ সেরে তার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন আক্ষরিক অর্থেই নিতুর চোখ প্রমান সাইজ রসগোল্লার মত হয়ে গেল। সে কিছুক্ষণ কিছু বলার চেষ্টা করে না বলতে পেরে প্রায় কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল এবং বলেই ফেললো, তুই শেষ পর্যন্ত সব শেষ করেই দিলি? জান্নাতের মুখে তখন এক বিচিত্র হাসি, তাতে কিছুটা কৌতুক কিছুটা বিদ্রুপ আর হয়ত একটু সহানুভূতি। সে দুহাতে নিতুকে জড়িয়ে ধরে বললো, রাগ করিস না লক্ষ্মীটি। তুই তো জানিসই কেন চুলগুলো কাটা জরুরী ছিল। নিতু নিজেকে জান্নাতের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রায় কান্নার স্বরে বললো তাই বলে তুই একেবারে টাক করে ফেলবি? যদি একটা বয়কাট দিতি তাহলেও এত খারাপ লাগতো না, তোর এত সুন্দর চুল!একটু মায়াও লাগলো না সব কেটে ফেলতে? আসলে নিতু জান্নাতের প্রাণের বন্ধু তাই এই চুল কাটার অভিযানে নিতুকে সে সাথে এনেছে। যদিও সে এব্যাপারে মোটেও রাজি ছিল না তাই পার্লারের মেয়েটা যখন এত্তবড় কাঁচি দিয়ে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে তার ঘন কালো চুলের বোঝা কেটে দিচ্ছিল তখন নিতু আর সহ্য করতে না পেরে বাইরের বারান্দায় এসে বসেছে। পার্লারের মেয়েটারও মনে হয় এত সুন্দর চুল এভাবে কাটতে মন চাইছিল না তাই সে বার বার জিজ্ঞাসা করছিল আসলেই সে মাথা ন্যাড়া করবে কিনা। সেখানে উপস্থিত সবাই ওকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছিল কিন্ত জান্নাতের এক জিদ।
নিতুর অভিযোগ জান্নাত মোটেও গায়ে মাখল না বরং নিজের ন্যাড়া মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, দেখ আমার খুলির সাইজ দেখার এমন সুযোগ আর পাবি কখনো? আমার মাথাটা বেশ সুন্দর না? ন্যাড়া মাথাতেও আমাকে বেশ গর্জিয়াস লাগছে, তাইনা? নিতু মুখ বাঁকিয়ে বললো আর ঢং করিস না। তোকে দেখতে প্রমাণ সাইজ কাতল মাছের মত লাগছে। রোনালদো ও তোকে দেখলে চমকে যাবে। জান্নাত একটা অট্টহাসি দিয়ে ব্যাগ থেকে রঙ্গিন একটা স্কার্ফ বের করে মাথায় জড়িয়ে নিল তারপর বলল, চল আজ এই বিশেষ দিনে সঙ্গদানের জন্য তোকে গ্রিল চিকেন খাওয়াই। এই বলে সে নিতুকে টানতে টানতে একটা রেস্টুরেন্টের দিকে নিয়ে গেল। সন্ধ্যায় হলে ফিরে বাথরুমে গোসল করতে ঢুকে সে নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ কেঁদে নিলো। তার চুলগুলো তার নিজেরও ভীষন প্রিয় ছিল। কিন্ত কি করা তার সিদ্ধান্তে সে অটল।

ছোটবেলা থেকেই জান্নাত বেশ রূপসী।মাঝারি উচ্চতার, মাঝারি স্বাস্থ্যের জান্নাতকে দেখতে অনেকটা পুতুল পুতুল লাগে। ফর্সা গায়ের রং, ফোলা ফোলা গালে গোলাপী আভা। তার মিষ্টি চেহারাটাকে ফ্রেম করেছে কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া এক রাশ কুচকুচে কালো চুল। কিন্ত এই মুগ্ধ করা রূপই তার জীবনের সমস্ত দুঃশ্চিন্তার কারণ। তাদের যৌথ পরিবার তাই সবাই একবাড়িতেই থাকে। জান্নাতের বাবা বেশ পুরোনো চিন্তার লোক। জান্নাতের মনে হয় তার বাবার জীবনের একটাই লক্ষ্য আর সেটা হচ্ছে জান্নাতের বিয়ে দেয়া। আর পাড়ার মানুষজনও যেমন, সে যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন পাড়ার এক চাচি তার ভাইয়ের সাথে জান্নাতের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে। ব্যস, সেই থেকেই বাবার মাথায় ঢুকেছে মেয়ের বিয়ের পোকা। যদিও তিনি মেয়েকে খুবই ভালবাসেন, সব আবদার রাখেন কিন্তু এই পোকা তার মাথা থেকে বের করা অসম্ভব।বড় চাচুমনিও জান্নাত কে খুবই আদর করেন কিন্ত তারও এক অভিমত। কেউ যদি বিয়ের কথা পাড়ে অমনি দুই ভাই মিলে লেগে যায় খোঁজখবর করতে। আপত্তি করলেই শুরু হয় লেকচার, এই বাড়ির কোন মেয়ের কত কচি বয়সে বিয়ে হয়েছিল; মা চাচীরা কত কম বয়সে বালিকাবধূ হয়ে এই বাড়িতে এসেছিল ইত্যাদি।
বড় চাচুমনি তো তার মেয়ে ফারিহা আপুকে কলেজ শেষ হতে না হতেই বিয়ে দিয়ে দিল। ফারিহার গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা। চাচুর এক কথা অসুন্দর মেয়ে ঘরে জিইয়ে রাখার কোনো মানে হয় না, ইঞ্জিনিয়ার পাত্র পাওয়া গেছে এখনি বিয়ে দেয়া উচিৎ। আপু কত মন খারাপ করল, কত কাঁদল তবু কেউ কথা শুনল না। অথচ আপু পড়ালেখায় কত ভাল ছিল, জান্নাতের চেয়েও ভাল। নির্ঘাত সে ঢাকা ভার্সিটিতে ফাটাফাটি একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে পারত। কিন্ত বিয়ের পরে তার আর পড়া হল না, দুবছরের মধ্যে বাচ্চা হয়ে গেল তাই স্থানীয় কলেজে ভর্তি হয়েও শেষে ছেড়ে দিতে হলো। জান্নাতের ক্ষেত্রে চাচুর যুক্তি হচ্ছে সুন্দর মেয়ে বেশি দিন ঘরে রাখতে হয় না। কি অদ্ভুত যুক্তি!
জান্নাতের তার পরিবারের এইসব চিন্তাই অসহ্য লাগে। মা-চাচিও যেন কেমন, হ্যাঁও বলেনা নাও বলেনা। একমাত্র ছোট চাচুমনি তাকে একটু সাপোর্ট দেয় কিন্ত বাবাদের ভয়ে সেও বেশি কিছু করতে পারেনা। জান্নাতের এসএসসি পরীক্ষার পর তো তার বাবা এক মোল্লার সাথে তার বিয়ে প্রায় দিয়েই ফেলেছিল। জান্নাতের কান্না দেখে ছোটচাচু যদি গোপনে নাবালিকা বিয়ের অপরাধে পুলিশের ভয় দেখিয়ে ঐ পার্টিকে না ভাগাতো তাহলে তার আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হত না। জান্নাত পিওর হাউসওয়াইফ হওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারেনা। তার জীবনে কত্ত স্বপ্ন! বাড়িতে থাকলে মা-চাচিদের জীবন দেখলে তার অবশ্য খারাপ বলে মনে হয় না। সবাইকে দেখেশুনে রাখা, সবার যত্ন করা, বাচ্চাদের মানুষ করা সব মিলিয়ে কেমন একটা স্নিগ্ধ মায়া আছে তাদের জীবনে। কিন্ত জান্নাত নিজের জীবন থেকে আরো বেশি কিছু চায়। কতকিছু জানার আছে, দেখার আর শেখার আছে।তার ইচ্ছা সে অনেক পড়ালেখা করবে তারপর একটা ভাল চাকরি করবে। তখন সে যখন যা ইচ্ছা কিনতে পারবে। পরিবারের সবাইকে এটা সেটা কিনে দিতে পারবে, আর তার খুব ইচ্ছা পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে। তবে সবচেয়ে বড় হচ্ছে স্বাধীন আর স্বাবলম্বী হওয়া। এসবের জন্য তো তাকে মন দিয়ে পড়ালেখা করতেই হবে।
জান্নাত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে প্রায় পাঁচ মাস হতে চলল। গরমের ছুটি শুরু হয়েছে এবার বাড়ি যাওয়ার পালা কিন্ত ছোট ভাইয়ের কাছে সে শুনেছে বাবা আবার পাগলামি শুরু করেছে জান্নাত বাড়িতে গেলেই ছেলেপক্ষ তাকে দেখতে আসবে। অনেক ভেবে তাই সে ঠিক করেছে যে নিজের চুল কেটে ফেলবে। এবার তো আর বয়সের অযুহাত দিয়ে ঠেকাতে পারবে না কিন্ত চুলহীন কোনো মেয়েকে নির্ঘাত ছেলে পক্ষ পছন্দ করবে না। তার এই প্রস্তাব শুনে বান্ধবীরা সবাই একযোগে আর্তনাদ করে উঠেছিল। তখন জান্নাত বলেছিল, তোরা কি চাস আমাকে কোনো হুজুরের সাথে বিয়ে দিয়ে দিক আর সমস্ত জীবন আমাকে পর্দাঘেরা বাড়ির মধ্যে কাটাতে হোক। নিশাত বলেছিল, কিন্ত তুই চুল কাটলে বাসার সবাই বকবে না? জান্নাত বলেছিল তা বকবে কিন্ত কিছু একটা বলে ম্যানেজ করা যাবে আশা করি। সবাই আমাকে অনেক ভালবাসে কিন্ত যদি শুধু এই বিয়ের পাগলামিটা না করত! বর্ষা তার স্বভাবসুলভ ঢংমেশানো স্বরে বলেছিল, ইশ তুই চাস না কিন্ত তোর বাবা মা কি সুন্দর তোর বিয়ে দিতে চায়। আমি বিয়ে করতে চাই কিন্ত আমার বাবা মা একবারও সে কথা বলে না। তার কথা শুনে সবাই একচোট হেসেছিল।
শেষ পর্যন্ত জান্নাতের ইচ্ছে পূরণ হলো।বাসায় যাওয়ার পর তার ন্যাড়া মাথা দেখে সবাই আঁতকে উঠল, জান্নাতের মা তো প্রায় মূর্ছা যায় এমন অবস্থা। সবাই যখন জানতে চাইলো কেন এমন হল তখন সে সরল মুখ করে বলেছে, তোমরা তো জান না হলের গণরুমে কত তেলাপোকা। রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম তেলাপোকাতে জায়গায় জায়গায় চুল এমন ভাবে কেটেছে যে শেষে চুল ন্যাড়া করতে হলো। আরো দুজন মেয়ের এমন ন্যাড়া করতে হয়েছে। নইলে কি আমার এমন সুন্দর চুল আমি ন্যাড়া করি? যতই আজব হোক এমন অকাট্য যুক্তি না মেনে আর উপায় কি? তাই বাসার লোক শান্ত হলো, বিয়ের আপদও বিদায় হলো। দিন যায়, জান্নাতের চুল বড় হয়ে ঘাড় ছেয়ে পড়ে কিন্ত জান্নাত প্রতিবার বাড়ি যাওয়ার আগে ছেলেদের মত করে চুল ছেঁটে ফেলে। ছোট চুলেও জান্নাতের মুখের মিষ্টতা ম্লান হয় না কিন্ত ছেলের মায়ের মেয়ের চুল দেখে পছন্দ হয় না তাই বিয়ের কথাগুলো আগায় না। এভাবেই দুটি বছর কেটে গেল। জান্নাতের পড়ালেখার খাতিরে চুল বিসর্জন দেয়ার কাহিনী বান্ধবীদের মুখ থেকে অনেকেই জেনে গিয়েছে। এইজন্য সমস্ত হলে তাকে সবাই বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখে। জুনিয়রদের কাছে তো সে রীতিমত বিদ্রোহী নারীত্বের প্রতিমূর্তি।