লিখেছেন : সন্ধ্যা প্রদীপ
এমন সেলিব্রিটি ইমেজ নিয়ে তার দিনগুলো ভালই কাটছিল এমন সময় ডিপার্টমেণ্টের একটি ব্যাচের নবীনবরন উপলক্ষে অনেক বড় অনুষ্ঠান করার প্রস্তুতি শুরু হলো। সব ব্যাচ অংশ নেবে এতে। সে যেন এক আনন্দ মেলা। প্রতি দিন বিকেলে রিহার্সেল হয়,আড্ডা হয় আরো কত কিছু। একটা ফ্যাশান শো আর একটি যুগল নাচ। পার্টনার তিন ব্যাচ সিনিয়র রিয়াদ ভাই। রিহার্সাল চলতে লাগল পুরোদমে। রিয়াদ ছেলে হিসাবে বেশ হ্যান্ডসাম, জান্নাত তাকে আগেও অনেকবার দেখেছে কিন্ত এই প্রথম বার কাছে থেকে ভাল করে লক্ষ্য করল। কি চমৎকার তার কথা বলার ভঙ্গি আর কি চমৎকার তার ব্যাক্তিত্ব। এই রিহার্সালের মধ্যে দিয়ে সবার সাথে সবার অনেক খাতির হয়ে গিয়েছে। জান্নাত যদিও অন্য সবার ব্যাপারে খুব সাবলীল কিন্ত রিয়াদ ভাইর কাছে তার কেমন যেন একটা সঙ্কোচ রয়েই গেল। যদিও সেটা শুধু সাধারন ক্ষেত্রে, রিহার্সালে তারা দুজনেই খুব ভাল করতে লাগল। তার ছোট চুল তাই তাদের জন্য ঠিক করা হয়েছে ওয়েষ্টার্ন গান। তাদের বোঝাপড়া এক্ষেত্রে এত ভাল হয়েছিল যে অন্যরা তাদের কাজ ফেলে ওদের রিহার্সাল দেখত।
আজকাল জান্নাতকে কেমন যেন একটা নেশায় পেয়ে বসেছে। সারাদিন বিকেলের জন্য মন উতলা হয়ে থাকে। আর বিকেল চলে গেলেও স্মৃতিগুলো পিছু ছাড়তে চায় না। সে বার বার নিজেকে আয়নায় দেখে আর নিজের মনেই হাসে। এর মাঝেই একদিন সে রিয়াদ আর তার বন্ধুদের কিছু আলোচনা শুনে ফেললো। মাস্টার্সের ব্যাচের কিছু ছাত্রছাত্রী ডিপার্টমেন্টের ক্যান্টিনের বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল ভেতরের ঘরে যে সে আছে তারা সেটা খেয়াল করেনি তাই এটা সেটা বলতে বলতে একজন হঠাৎ বলে ফেললো– আমি যে নাটকটা লিখেছি তাতে রিয়াদ কে নায়ক করবো ভাবছি কিন্ত মনমতো নায়িকা পাচ্ছিনা। অন্য একজন বলল কেন ওর পার্টনারকে নিয়ে নে। আগেরজন বললো, নাহ! ঐ মেয়ের তো চুল নেই গ্রাম ভিত্তিক কাহিনীতে একদম মানাবে না। অন্য আর একজন বললো, মেয়েটাকে কিন্ত আমাদের রিয়াদের সাথে খুব মানায়, পার্টনারশিপটা পার্মানেন্ট করে নে, কি বলিস রিয়াদ? তখন রিয়াদ বিব্রত গলায় বলে উঠল, আরেহ কি যে বলিস তোরা।বাজে কথা বলিস না। সবার একচোট হাসির মাঝেই একজন মেয়ে বলে উঠল, ওখানেও তো একই সমস্যা, চুল! আমাদের রিয়াদ দেখতে হাইফাই হলে কি হবে পছন্দ একদম কবরী-ববিতার যুগের মত ঘন কালো কেশবতী কন্যা। বয়কাট দিয়ে কি আর ওর মন ভরে? সবাই আর একচোট হেসে উঠল।
এইসব আলোচনা শুনে জান্নাতের গালদুটো লাল হয়ে উঠল। সে মনে মনে ভাবল, ও তাহলে আমাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আমার চুল নিয়ে মজা করা হচ্ছে?রূমে ফিরে আয়নাতে নিজের চেহারা দেখে চুল কাটার পর প্রথমবার তার আফসোস হলো। বারবার মনে হতে লাগল, ইশ যদি চুলগুলো এভাবে কেটে না ফেলতাম তবে কেউ আর আমাকে নিয়ে মজা করতে পারত না। একটা দিন তার এইসব ভাবনাতেই কেটে গেল, এমনকি সে ক্লাসে বা রিহার্সেলেও গেল না। তারপর হঠাৎ তার মনে হলো আচ্ছা, আমি তো আমিই।আমার চুল বা অন্য কিছু তো আমি নই শুধু আমার দেহের একটা অংশ। সেটা সাময়িকভাবে না থাকতে পারে কিন্ত আমি তো সম্পূর্নই রয়েছি তার সামনে। আমার সাথে মিশে আমাকে চেনার ও কাছ থেকে জানার সুযোগ সে পাচ্ছে। এতকিছুর পর যদি মানুষ হিসাবে আমাকে তার ভাল লাগে তবে সে নিশ্চয় চুলের মত তুচ্ছ কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে না। আর যদি কারো কাছে আমার চেয়ে আমার চুল বড় হয়ে দেখা দেয় তো সেই মানুষকে আমার দরকার নেই। নিজের এভাবে বুঝিয়ে জান্নাত মনটাকে স্থির করে।
পরদিন থেকে সে আবার রিহার্সেলে যাওয়া শুরু করে। রিয়াদের সেই বন্ধু অবশেষে নাটকের নায়িকা হওয়ার জন্য তাকে প্রস্তাব দেয়, অবশ্য তার জন্য একটা পরচুলা আনা হবে বলে ঠিক করা হয়। জান্নাত ভেবেছিল না করে দেবে কিন্ত হায়রে মানুষের মন! মোহ থেকে বের হওয়া কি এত সোজা? আর কিছু না হোক রিয়াদ ভাইয়ের একটু কাছে থাকা, তার গায়ের পারফিউম আর সিগারেটের ধোঁয়া মিশ্রিত পুরুষ পুরুষ গন্ধ, তার কথা শোনা। এটুকু ভাললাগার জন্যেই সে প্রস্তাব ছাড়তে পারেনা। একমাসের রিহার্সেলের পর দারুন একটা প্রোগ্রাম হয়। জান্নাত অনেক প্রশংসা পায়। তারপর দিন কাটতে থাকে আপন গতিতে। পরীক্ষা শেষে রিয়াদের বিদায়ের সময় হয়ে আসে। তারা পরিচিতদের নিয়ে একটা বিদায়ী ডিনারের আয়োজন করে কিন্ত বিশেষ নিমন্ত্রন সত্ত্বেও জান্নাত সেখানে যায় না। কেন যায় না তা সে নিজেও জানে না। বরং সেদিন সে পার্লারে গিয়ে ২য় বারের মত ন্যাড়া করে আসে।
এরপর কেটে গেছে আরো একটা বছর। জান্নাত এবছর অনার্স ফাইনাল দেবে। বহু ব্যস্ততার মাঝে তার দিন কাটে। কখনও হঠাত করে তার রিয়াদের কথা মনে হয় খুব অল্প সময়ের জন্য। আসলে মোহ অনেকটা বৃক্ষের মত, তার বীজ বপনের পর যত্ন করলে তবেই চারা বের হয় আর একদিন তা বিশাল আকার নেয়। জান্নাতের মনে মোহের বীজ বপন হয়েছিল সেইসব দিনে, চারাও গজিয়েছিল কিন্ত সে বুদ্ধিমান তাই হাওয়া পানি দিয়ে সেটাকে আর বড় হতে দেয়নি। নিজের জীবনে চেয়ে না পাওয়ার বেদনার কূপ খনন করেনি। শুধু মাঝে মাঝে হঠাৎ একটু ফিরে তাকায় মোহের চারাটির দিকে। ব্যস এ পর্যন্তই। সে শুধু একটা হিসাব মেলাতে পারেনা। নাটকের দিন স্টেজে ওঠার আগে লাল-সবুজ গ্রামীনচেক শাড়ি, রেশমি চুড়ি পড়ে যখন সে রিয়াদের সামনে যায় তখন রিয়াদের চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি ছিল।নিজের স্বপ্ন পুরুষের চোখে তীব্র মোহ আর মুগ্ধতার প্রথম দৃষ্টি যে দেখেছে সেই নারীমাত্রই জানে সে দৃষ্টি কেমন। জান্নাত হিসাব মেলাতে পারেনা, সেই দৃষ্টির কারণ কি সে না তার লম্বা নকল চুল সে তা আজও বোঝে না।
No comments:
Post a Comment