সেলুনে লাইনে বসে আছি। নিজের অতীত স্মৃতিগুলো মনে ভাসছে।
ছোটবেলা থেকেই আমার অনেক লম্বা ঘন চুল ছিল প্রায় হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছাত। চুল আঁচড়াতে হত দুইটা খোঁপা করে একটা খোঁপা খুললেই পুরো শরীর ঢেকে যেত। আমার মায়ের খুব পছন্দের ছিল আমার চুল তাই রোজ মাথায় তেল দিত আর বলতো “তোর চুলগুলো এত সুন্দর একদম মেঘের মত এত কোমল মায়াবী"। আমার চুল দেখতেও অনেক সুন্দর ছিল চুল খুলা থাকলে মুখমন্ডল দুপাশ ঢেকে যেত। নাইন টেন ইন্টারে পড়া আপুরা বলত “তোর এত সুন্দর চুল গুলা কেটে আমাকে দিয়ে দে আমি পরচুলা বানিয়ে পড়ব এই বয়সে এত বড় চুল দিয়ে কি করবি।”
‘আচ্ছা তাহলে অন্তত অর্ধেক কেটে দে তাও চলবে'। কিন্তু মা মানা করত 'কোনদিন চুল কাটবিনা!’
‘আচ্ছা তাহলে অন্তত অর্ধেক কেটে দে তাও চলবে'। কিন্তু মা মানা করত 'কোনদিন চুল কাটবিনা!’
শৈশব কেটেছে গ্রামেই। মাঠে ভাই-বোনদের সাথে খেলতাম। তারা কেন জানি অন্যরকম ভাবে দেখতো। মাঝে মাঝেই খোপা খুলে যেত আর রফিক বলতো 'এইভাবে তোকে একদম ডাইনির মত লাগে' তাই ওরা আমার চুল নিয়ে নানাভাবে খেলতো মাঠের মাটিতে রেখে চুলের উপর লাফালাফি করত নানা ভাবে ময়লা করত টানাটানি করত। মা তাই রাগ করত আবার খুশিও হত এত কিছুর পরও চুল ড্যামেজ হয়না।
স্কুলে যে বয়সে আমার বান্ধবীদের প্রায় সবার ছোট চুল কারো কারো সর্বোচ্চ পিঠ পর্যন্ত পৌছায় সেই বয়সে আমার প্রায় পা পর্যন্ত চুল। তাই মা শক্ত করে খোপা বেধে দিত ক্লিপ দিয়ে আর মাথায় পিন লাগাতে হত বিভিন্ন স্থানে। আমি স্কার্ফ দিয়ে মাথা পুরা ঢেকে রাখতাম তাও সবার কৌতুহল জাগতো কারন খোপা এত বড় হত। একদিন বান্ধবীদের অনেক জোরাজুরিতে স্কার্ফ খুলতে বাধ্য হলাম তারা বলল এত সুন্দর খোপা এত সুন্দর চুলের কালার রোদের আলোয় যেন ঝলমল করছে তাই আমাকে বাধ্য করলো খোপা খুলতে। এরপর থেকে আমার চুল সবার মধ্যমনি। সবাই চুলে চুমু খেতে মুখের সাথে ঘষতে লাগলো বলে এত কোমল চুল না ছুঁয়ে থাকা যায়না।
জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার দিন পরীক্ষক স্কার্ফের ভিতরে এত ফোলা দেখে জিজ্ঞাসা করল স্কার্ফের ভিতরে নকল নাকি? সেটা দেখবার জন্য অন্য রুমে নিয়ে আসে; এরপর চুল খুলে পুরুষ পরীক্ষক সমস্ত চুলে চুমু দিতে লাগল, পরে সারা শরীর জড়িয়ে ধরে মুখে চুমু দিতে লাগল তার মুখ আমার চুলের ভিতর ডুবিয়ে রাখল বলে এত সুন্দর চুল কখনো কল্পনা করেনি। আমার এত খারাপ লাগছিল কষ্টের কথা মা বাবাকে বলাতে তারা চুল ন্যাড়া করে দিলো। ইন্টারের এক বড় আপু আফসোস করে বললো 'এত সুন্দর চুল ডাস্টবিনে ফেলে না দিয়ে আমাকে দিতি’
ক্লাস টেনে পড়ার সময় চুল আবার হাটুর নিচ পর্যন্ত এখন। এই চুলের জন্য বান্ধবিদের কারো কাছে ঈর্ষার পাত্রী তো কেউ কেউ আমার চুলের পাগল। বারবার আমার খোপ খুলতে চায় যা আমার ভালো লাগেনা।
তখন হোম টিউটরের প্রেমে পড়ে যাই যদিও আমি গায়েগতরের দিক থেকে দেখতে তেমন সুন্দরী না। গায়ের রং শ্যামলা কিছুটা মোটা গড়নের। বান্ধবীরা বলত খোলা চুলে তোকে দেখলে এমনিই প্রেমে পড়ে যাবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা করত না এমন করতে। সেই রফিক স্যার আমাকে একদম পাত্তা দিতনা কথায় কথায় পড়া না পাড়লেই রাগতো পানিশমেন্ট দিতো তাই একদিন উপায় না পেয়ে খোলা চুলে পড়তে বসলাম। স্যার এর চোখ সরাতে পারছেনা সেইদিন খুব ভাল ব্যাবহার করলো। পানিশমেন্ট দিতে চাইলে লম্বা চুল তার দিকে মারতাম শরিরে ছোয়াতাম সে বললো "দে-দেখো এ-এসব কিন্তু ঠিক হচ্ছেনা"। তখন থেকে পড়াতে এসে শুধু আমার খোঁপা খুলতে চাইত। গোসল করে আসার পর আমার চুলের গন্ধ দিতে চাচ্ছে আমি গামছা দিয়ে চুলের ঝাপ্টা মারলাম।
এবার আচমকা স্যারের মোহভঙ্গ হল। ‘'নাহ্ এসব ঠিক হচ্ছেনা। আমি এসব কি করছি ছাত্রীর সঙ্গে!’' আমি তোমার চুল সব কেটে ফেলব এক্ষুনি বড় একটা কাঁচি আনো।
তার মন জয়ের জন্য আমি যেকোন কিছু করতে পারতাম। তাই যেমন বলা তেমনি করা। প্রায় দু'হাত চুল ধরল কাটবার জন্য। আমি বললাম আরো বেশি করে কাটেন। অনেকখানি কাটার পর অনেকটা লম্বা তাই স্যার কে বললাম আপনার প্রাণে যতখানি চায় কাটেন। স্যারের হাত কাঁপা শুরু করল। তারপর থেকে স্যার আমার চুলের পাগল।
তবে বাবা মা এত আহ্লাদ পছন্দ করেনি। ইন্টার পাশের পর বিয়ে দিয়ে দেয়। তখন চুল আবার আমার চুল হাঁটু ছুঁই ছুঁই।
তার মন জয়ের জন্য আমি যেকোন কিছু করতে পারতাম। তাই যেমন বলা তেমনি করা। প্রায় দু'হাত চুল ধরল কাটবার জন্য। আমি বললাম আরো বেশি করে কাটেন। অনেকখানি কাটার পর অনেকটা লম্বা তাই স্যার কে বললাম আপনার প্রাণে যতখানি চায় কাটেন। স্যারের হাত কাঁপা শুরু করল। তারপর থেকে স্যার আমার চুলের পাগল।
তবে বাবা মা এত আহ্লাদ পছন্দ করেনি। ইন্টার পাশের পর বিয়ে দিয়ে দেয়। তখন চুল আবার আমার চুল হাঁটু ছুঁই ছুঁই।
হঠাৎ আওয়াজ এলো "ম্যাম আপনার সিরিয়াল এসেছে চলুন" চোখ ঘোরাতেই দেখি সেলুনের এক কর্মী। চেয়ারে গিয়ে বসলাম। নাপিত খোঁপার পেন্সিল আর মাথার পিন গুলো খুলার পর বেরিয়ে আসলো এক মেঘ চুল। চেয়ার আর উচু করা যাচ্ছেনা বলে নাপিত।
আমার কি কপাল! আমার মত সুকেশার কপালে জুটল কিনা এমন এক স্বামী যে লম্বা চুল ঘৃণা করে। বিয়ের পর আমার মাথা ভরা চুল দেখার পর রাগে আগুন। কিন্তু শাশুড়ি ও মায়ের মত লম্বা চুল কেটে ছোট করতে একদম মানা। এদিকে শ শ্যালিকা আমাকে দেখতেই পারেনা বলে: “দেখব কতদিন তোমার এই চুল থাকে।"
আমার স্বামী সবসময় হয়ত ইচ্ছে করেই ডেট ওভার হওয়া শ্যাম্পু, তেল আনতো আমার জন্য। আমি এগুলো হাসিমুখে ব্যবহার করতাম। আলাদা বাসা নেয়ার পর থেকে আরও অনেক কিছু শুরু হয়। যেমন ময়লা কাপড়ের পরিবর্তে আমার লম্বা চুল দিয়ে ঘর মুছাতো। এত জোড়ে টান দিয়ে মোচড়াতো যে খুব ব্যাথা হত আর বলত ‘যতদিন তোর এই চুল থাকবে ততদিন তোর প্রতি আমার কোন ভালবাসা নাই।’ শাশুড়ি কেবলই বলে "সমস্যা নেই একদিন তোর চুলে পাগল হয়ে যাবে আমার ছেলে দেখিস।"
যাক এসবের মাধ্যমে একবার চুল পড়া শুরু হলে আর এই সৌন্দর্য থাকবেনা তখন মা শাশুড়ি কে মানাতে পারব চুল কাটতে। কিন্তু আমার কি কপাল। এত কিছুর পর ও একটা চুলও পড়েনা। চুলের শাইন আর লাবণ্য একটুও কমেনা। কেন যে এমন চুল নিয়ে জন্মালাম।
৭ বছর পর, আজও সে আগের মতই ডেট এক্সপায়ার্ড শ্যাম্পু আর চুল দিয়ে ঘর মোছা জারি আছে। অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক চলে তার। আজও সন্তানের মুখ দেখলাম না। তবে এখন অনেক চুল পড়া শুরু হয়েছে। চুলে আর আগের লাবণ্য নেই। তবে এখন কি মানাতে পারবো তাদের।
বাবার বাড়ি যাবার পর মা এসেছি দেখেই আগে আমার খোঁপা খুলে দেখলেন— বাহ! এখনো কি সুন্দর আমার মেয়ের চুল। আমার মুখে হতাশার ছাপ দেখে হয়ত মায়ের মুখের হাসিও ম্লান হয়ে গেল।
তার পরের দিন স্বামী মদ্যপ অবস্থায় বাসায় এসে আমার মোটা বেণী দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে বলছিল:– দেখি তোর এই চুল আজকে কিভাবে থাকে! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল আর চোখ দিয়ে পানি বেয়ে পড়ছিল।
নাহ! এসব আর কতকাল সহ্য করব! ভেবে ভেবে রান্নাঘরে কাঁদছিলাম তখন চোখ গেল চুলায় ফুটন্ত গরম পানির দিকে। তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। এরপর খোপার কলম আর পিন গুলো খুললাম আর সমস্ত চুল ফুটন্ত পানিতে ডুবালাম আর ভাবতে থাকলাম সেই দিনগুলির কথা। সেই মাঠে একসঙ্গে খেলা, জুনিয়র বৃত্তি পরিক্ষার পরীক্ষকের সেই নোংরামি সব স্মৃতিগুলি ফুটন্ত পানিতে ভেসে আসছিল তাই চেয়েই থাকলাম সেই দিকে।
ম্যাডাম কতটুকু কাটব? আপনার চুল মারাত্মক ড্যামেজড কিন্তু চুলের ঘনত্ব, লেংথ, শাইন সবকিছুই সুন্দর। আমি বললাম- কাটতে থাকুন যতক্ষণ না এই সব চুল শেষ হয়ে যায় এই সব কস্টের মূল শেষ হয়ে যায়! "
–ওকে ম্যাম তাহলে আপনাকে বয়কাট দেই কারন মাথার কাছের চুলগুলো একটুও ড্যামেজ হয়নি; খুব সুন্দর দেখতে।
–ওকে ম্যাম তাহলে আপনাকে বয়কাট দেই কারন মাথার কাছের চুলগুলো একটুও ড্যামেজ হয়নি; খুব সুন্দর দেখতে।
বয়কাট দেয়ার পর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম এরপর মাটিতে পড়ে থাকা চুলের সমুদ্রের দিকে তাকালাম। তারপর হঠাৎ আয়নার দিকে তাকিয়ে বললাম ‘‘এবার মাথা পুরো ন্যাড়া করে দিন আর মেডিসিন দিয়ে দিন যেন আর চুল না গজায়।’’
আজ হয়ত বড় আপুরা নেই যে বলবে চুলগুলি ফেলে না দিয়ে তাদের দিয়ে দিতে। আজ হয়ত সেই স্যারও নেই যে এই চুল কাটতে দেখে মায়া লাগবে।
[সংগৃহীত]
No comments:
Post a Comment